বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিসিজম: বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে ভারতচন্দ্রের পূর্ব পর্যন্ত কবিদের রচনায় যুক্তির বদলে আত্মপ্রকাশই বেশি মূল্য পেয়েছে। তবে, বড় চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং কিছু চৈতন্যজীবনীমূলক কাব্যে ক্লাসিক ধর্মী আত্ম বিলোপের (অর্থাৎ কাব্যে নিজের অবস্থানকে অপ্রকাশিত রাখা) দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্যে ক্লাসিকরীতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। তাঁর অল্প শব্দে পূর্ণভাব প্রকাশের ক্ষমতা, ক্ষুদ্র শ্লেষাত্মক কবিতা Epigram রচনার দক্ষতা, মাত্রানিষ্ঠা ক্লাসিক্যাল রীতিরই পরিচয় বহন করে। বিশেষত ব্যক্তিগত জীবনের ছাপ কোনোভাবেই তাঁর কাব্য সাধনার অনুরূপিত হয় ি নি।
ভারতচন্দ্রের পর রাজা রামমোহন রায়ের লেখায় ক্লাসিকরীতির লক্ষ করা যায়। বিশেষত, তাঁর লেখায় ক্লাসিক রূপটিই ধরা পড়ে। তার লেখাগুলো গুরুগম্ভীর, সংহত, স্বচ্ছ ও যুক্তিনিষ্ঠ এবং সর্বোপরি শিষ্ট- হোরেসের decorum এর তত্ত্বকেই তিনি অনুসরণ করেছেন।
ঈশ্বরগুপ্ত তাঁর কবিতার আঙ্গিক সৃষ্টিতে ভারতচন্দ্রকেই অনুসরণ করেন। তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে খতি প্রান্তিক ছন্দ, পরিমিতি ও বস্তুনিষ্ঠা। কবিতার পঙ্কৃতিকে অল্পকথার বন্ধনে নিয়ে আসার চেষ্টা এবং আঙ্গিক তৈরির ক্ষেত্রে নতুনত্ব না আনার প্রয়াস তাঁকে ক্লাসিক শিল্পীদেরই একজন করে তুলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাইকেল মধুসুদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য ক্লাসিকরীতি অনুসরণ করেই লেখা একটি বিশিষ্ট শিল্প সাহিত্য। প্রাচীন মহাকাব্যিক ধারাকে অনুসরণ করে নায়কের বীরত্ব প্রকাশে স্বার্থকতা এবং এর গুরু-গম্ভীর্য একে ক্লাসিকাল অনুসারী করে তুলে। যদিও, অমিত্রাক্ষর ছন্দের আবির্ভার একে ক্লাসিক রীতিকে ভঙ্গের দোষে দুষ্ট করে, তবুও সার্বিক দিক বিবেচনা করলে একে ক্লাসিক ধর্মী বলাই শ্রেয়।
রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বিষ্ণুদের ব্যঙ্গমিশ্রিত কবিতায় এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যে ক্লাসিকরীতির বিলক্ষণ চোখে পরে। তাঁদের উদ্দেশ্য করেই জীবনানন্দ দাশ বলেন- “কোনো কোনো কবির হাতে ক্লাসিক বা মাত্রানিষ্ঠ রীতির এমন একটা প্রতিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যা রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সমসাময়িক কবিদের ভিতর প্রায়ই ছিল না।”
শুধু কবিতা নয়। মননশীল উপন্যাসকেও বর্তমান যুগ সাপেক্ষে ক্লাসিকরীতি ধর্মী বলা চলে। বিশেষভাবে ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অন্নদাশ রায়ের লেখাগুলোকে ক্লাসিক্যাল বলা যায়। এই সময় থেকে আর দু’দশক এগিয়ে কমলকুমার মজুমদারের গদাশৈলীর ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল ভঙ্গিও আমাদের মূল্যবান উত্তরাধিকার।
নিও-ক্লাসিক্যাল ধারণা প্রাচীন ক্লাসিক্যাল ধারণার অনড়তা ভেঙে দিতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছিল এবং নতুন যুগের মানুষের রুচি, আদর্শ, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতেও সক্ষম হয়েছিল। কোন সন্দেহ নেই এই পথ ধরেই রোমান্টিকতার আবির্ভাব। নব্য ধ্রুপদীবাদ বা নিও-ক্লাসিসিজম সামাজিক মনকে এবং মানব সমাজকে প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিল। অপরপক্ষে রোমান্টিসিজম এর তত্ত্বে সামগ্রিক গুরুত্ব ছিল ব্যক্তিমনের প্রতি। স্রষ্টার হৃদয় এবং শ্রোতা বা পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে ব্যক্তিগত সেতুবন্ধনই সেখানে মূল লক্ষ্য। কোনো নীতিবোধ, ঔচিত্যবোধ বা সামাজিক আদর্শের সেখানে কোনো ভূমিকা নেই। এভাবেই রোমান্টিক ধারণার উদ্ভব ঘটে এবং পরবর্তীতে এ ধারা বিস্তার লাভ করে।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
ক্লাসিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন
ক্লাসিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
ক্লাসিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়