১. রোমান্টিসিজমের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ব্যক্তিনিষ্ঠতা অর্থাৎ কবির একান্ত ব্যক্তিগত ভালোলাগা ও মন্দলাগার প্রকাশ। রোমান্টিক সাহিত্যে কবির আত্মভাবই প্রধান।রোমান্টিক কবি যখন সাহিত্য রচনা করেন তখন তাঁর রচনায় অন্য কারো প্রসঙ্গ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে না। এখানে কবির তীব্র অনুভূতিই প্রকাশিত হয়।কোথাও কোনো কৃত্তিমতার ছাপ থাকে না।Tord Bayron এর She Walks in Beauty কবিতায় এই ব্যক্তিগত চিন্তা ও ভালোলাগার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনঃ
“She walks in beauty,like the night
of Cloudlness climes and starry skies;
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes.”
২. রোমান্টিসিজমের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল স্বেচ্ছাচারিতা।সাহিত্যের প্রচলিত রীতি ও পদ্ধিতিকে অস্বীকার করা।রোমান্টিক কবির মনই বড় সত্য এবং সংবেদনশীল।প্রচলিত কোনো কিছুতেই তিনি তৃপ্ত নন।তাই পূর্বাপর সাহিত্যের বাধাঁ ধরা নিয়ম ও রীতি-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।তাঁর এই বিদ্রোহ মূলত দুদিকে প্রবাহিত-১।বিষয়বস্তু নির্বাচনে ২।রচনার রীতি পদ্ধিতিতে
রোমান্টিক কবির এই স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের ফলেই,
১. বস্তুতান্ত্রিক জীবনভাবনা প্রত্যাখ্যাত হয়।
২. ছন্দ ও অলঙ্কারের কঠোর বন্ধন বাতিল হয়।
৩. রোমান্টিসিজমের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল গতিশীলতা,অর্থাৎ বাস্তব জগতের রূপ ছাড়িয়ে স্বাধীন-প্রমত্ত-প্রচণ্ড-স্বেচ্ছাচারী কল্পনায় ভেসে যায়।রোমান্টিকদের এ গতি অসংযত গতি, যাতে কবির কখনো অতীতচারী হয়, আবার কখনো পৌঁছে যায় স্বপ্নলোক,অলৌকিক বা অতিলৌকিক ভাবনার রাজ্যে।রোমান্টিকদের অসংযম ভাবনার কারণঃ
১. সমকালীন যুগ ও জীবনের প্রতি কবির অনাস্থা।
২. সামাজিক অনুশাসন না মানা এবং শৃঙ্খলাকে ভাঙ্গা
৩. প্রাতিষ্ঠানিক গৌরবকে ঘৃণা করা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, “আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে; জীবনানন্দ পৌঁছে যান-বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে।”
এমন করেই রোমান্টিক কবিরা তাদের সাহিত্যের/কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করে প্রাচীন ইতিহাস থেকে, পুরনো লোককথা, রূপকথা থেকে কিংবা প্রাচীন লোকগাঁথা ও কাহিনি থেকে।রোমান্টিক কবিরা যে শুধু অতীতকে খুঁজে ফিরে তা নয়।অনেক সময় বর্তমান জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আপন কল্পনাবলে কাব্যে অতিপ্রাকৃতের জগত নির্মাণ করে সেখানে এক অপার্থিব, রহস্যময় অভিনব সৌন্দর্যলোকের সৃষ্টি করে।যেমনঃ কীটসের ‘ল্যামিয়া’ , ইসাবেলা, কোলরিজের এনসিয়েন্ট ম্যারিনার, রবীন্দ্রনাথের সিন্ধুপারে , জীবনানন্দের বনলতাসেন’- প্রভৃতি কবিতায় এই রহস্যানুভব ধরা পড়ে।
৪. রোমান্টিক সাহিত্যিকদের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হল স্পর্শকাতরতা। রোমান্টিক কবির মন বড়ই সংবেদনশীল। সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে পড়েন, আবার সামান্য আনন্দেই উচ্ছ্বাসিত হন।কোনো কিছুতেই তারা তৃপ্ত হন না।তাই তাঁরা সর্বদাই ভোগেন হতাশায়, যন্ত্রণায়, নৈরাশ্যে ও বিষন্নতায়। জীবনের কোনো কিছুতেই পূর্ণতা খুঁজে না পেয়ে দগ্ধ হন অপূর্ণতায়।জাগতিক ক্ষয়-ক্ষতিতে তিনি চিৎকার করেন।চোখের সামনে যা কিছু দেখেন, তাঁর কোনো কিছুতেই স্বস্তি ও শান্তি পান না।রোমান্টিক কবিদের এই হাহাকার কে Romantic Malankoly ও বলা যায়।রোমান্টিক কবি যা চান পান না, আর যা পান তা প্রত্যাখ্যান করেন।তাই রোমান্টিক কবি বিহারীলালের মন সর্বদাই হু হু করে।
তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন, “চিরদিন মোর হাসালো-কাঁদালো,চিরদিন দিল ফাঁকি”
শেলী, কীটস, কোলরিজের কবিতায় এই রোমান্টিক বিষণ্ণতা পাঠাককে বিমূঢ় করে দেয়। শেলীর কবিতায় উচ্চারিত হয়,
“We look before and after and bine for what is not”
৫. রোমান্টিসিজমের পঞ্চম লক্ষন হল সৌন্দর্যের উপাসনা।রোমান্টিকরা সর্বদাই এক শাশ্বত সৌন্দর্যের উপসক।তবে আমরা সাধারন মানুষ যে অর্থে সুন্দরকে বুঝি রোমান্টিক কবিরা সেই অর্থের অনেক ঊর্ধ্বে গিয়ে সুন্দরকে খোঁজার চেষ্টা করেন।তাঁরা শাশ্বত সত্যের মাঝে সুন্দরকে খোঁজেন।কীটসের কবিতায় এই শাশ্বত সৌন্দর্যের কথা পাওয়া যায়। কীটসের কবিতায়,
“Beautu is trouth,trouth is beauty.”
সৌন্দর্যেকে খুঁজে পেলেই যেন রোমান্টিক কবিদের অন্তরাত্মার মুক্তি ঘটে।তাইতো সৌন্দর্য পিপাসু জ্ঞানদাস বলেন,
“রুপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।”
৬. রোমান্টিসিজমের ষষ্ট বৈশিষ্ট্য হল অভিনব প্রকৃতি-প্রতি।রোমান্টিক কবিরা সৌন্দরকে পূজারী বলেই প্রকৃতির মাঝে তাঁরা এক সজীব ও বৈচিত্রময় সত্তা আবিস্কার করে।তাকে ঘিরেই রোমান্টিক কবিরা অনন্ত সত্তা ও অপার রহস্যবোধ জাগ্রত হয় এবং তিনি ভাবাবেগ আন্দোলিত হন।তাঁর মাধুর্যময় বর্ণনা প্রকৃতিকে লীলাচপল করে তুলে।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
রোমান্টিসিজম কী বা রোমান্টিসিজম কাকে বলে?
রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
রোমান্টিকদের রচনার বিষয়বস্তু আলোচনা করুন
রোমান্টিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
রোমান্টিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
সঙ্গীতের উপর রোমান্টিসিজমের প্রভাব
শিল্প ও চিত্রকলায় রোমান্টিকতার প্রভাব
স্থাপত্যশিল্পে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
প্রকৃতির মাঝে এক অন্তহীন আনন্দ অন্তর্লীন প্রশান্তি খুঁজে পান রোমান্টিক কবিরা।ইয়েটস,ওয়ার্ডয়ার্থ,শেলী,রবিন্দ্রনাথ অ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই প্রকৃতি-প্রীতি পাওয়া যায়।
W.B. Yeat এর The lake isle of Innisfree কবিতায়,
“I will arise and go now ,and go to Innisfree And a small cabin build there,of Caly and wattles made,
Nine bean-rows will I have three,a
hive for the honey-bee,
And live alone in the bee-loud glade.”
কিংবা জীবনানন্দ দাসের আকাশের সাতটি তারা কবিতায়,
“আকাশের সাতটি তারা যখন ঊঠেছে ফুটে আমি
এই ঘাসে
বসে থাকি;কামরাঙ্গা লাল মেঘ যেন মৃত
মনিয়ার মত
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে – আসিয়াছে
শান অনুগত”
৭. রোমান্টিসিজমের সপ্তম লক্ষন আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা।অনেক রোমান্টিক কবির মন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত ছাড়িয়ে এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক জগতে ঘুরে বেড়ায়। বাস্তবের কোনো কিছুকে অবলম্বন করে কবি এক ঊর্ধ্বচারী লীলাকে প্রত্যক্ষ করে।এই হল কবির আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা।শেলী তাঁর স্কাইলার্কের অভিনব সুরে সেই ঊর্ধ্বগামী আধ্যাত্মিকতাকে স্পর্শ করেছে।
শেলীর To the Skylark কবিতায়,
“Hail to thee,blithe spirit!
Brid thou never went,
Thet from Heaven,or near it,
Pourest they full heart
In profuse strains of unpremeditated art,”
অথবা,রবীন্দ্রনাথের “চিত্রা” কবিতায়,
“জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে, তুমি বিচিত্র রুপিণী”
বা, “অন্তর মাঝে তুমি একাকী,তুমি অন্তর ব্যাপিণী।“
৮. প্রচলিত কাব্যদর্শনের বিরুদ্ধে বিরোধীতা করা রোমান্টিক কবিদের অষ্টম বৈশিষ্ট্য।প্রচলিত ভাষা ,ছন্দ,অলংকার নির্মাণে প্রথাসিদ্ধ পথে চলতে নারাজ।প্রচলিত কাব্যরীতিকে কৃত্তিম বলে মনে করতেন ওয়ার্ডসওয়ার।লিরিক্যাল ব্যালার্ডস এর মুখবন্ধে রোমান্টিকদের ভাষা এবং শৈলী কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।যা কিছু পুরনো,শৃংখলাবদ্ধ ও প্রথাসর্বস্ব তার বিরুদ্ধে রোমান্টিক কবিরা বিদ্রোহ ঘোষনা করেছেন।শেলী,বায়রন,কীটসের লেখায় ও বাংলা কল্লোলগোষ্টীর কবিদের মাঝে এই বিদ্রোহ লক্ষ করা যায়।
প্রচলিত ক্লাসিক রীতিতে ছন্দের বন্ধনে ভাব বন্দী হয়ে থাকতো।রোমান্টিক কবিরা সেই বন্ধনে ভাঙলেন।প্রাচীন রীতিতে ছিল চাটুকারীতা,সংযত,বুদ্ধিপ্রধান ভাশা।রোমান্টিকরা সেই ভাষাকে বর্জন করে কাব্যের ভাশাকে করে তুললেন আবেগপ্রবণ।
৯. পাঠকের মনে তীব্র বিস্ময় ও রহস্য সৃষ্টি রোমান্টিক কবিদের নবম লক্ষন।রোমান্টিকতা হল বিস্ময় ও রহস্যের উদ্ভোধক।রোমান্টিক কবি এমনভাবে তাঁর কাব্য নির্মাণ করবে যাতে পাঠকের মনে বিস্ময় জাগবে,চেতনার চমক লাগবে,মনে শিহরন জাগাবে।সীমাহীন আলো ছায়াআ পাঠকের চক্ষু বিস্ফোরিত হবে।যা ছিল অতি তুচ্ছ,অবহেলা ও আপাঙ্তেয়,তার মধ্যে ফুটে উঠবে অনন্য সাধারণ মহিমা।রোমান্টিকদের ভাবনায় যে পাহাড় নড়তে পারে না,সে হবে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘের মতো চলমান,যে তৃণতরু মরু ছিল প্রানহীন,তাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে,রহস্যাবৃত বাণী।যে প্রেম ছিল দেহসর্বস্ব ,তা সমুজ্জল হয়ে উঠবে সৌন্দর্যে।তখন বস্তু নয়,কবি রচনা করবেন তা হয়ে উঠবে সত্য-
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি,কবি তব মনেভূমি
রামের জনম স্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনে।”
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
রোমান্টিসিজম কী বা রোমান্টিসিজম কাকে বলে?
রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
রোমান্টিকদের রচনার বিষয়বস্তু আলোচনা করুন
রোমান্টিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
রোমান্টিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
সঙ্গীতের উপর রোমান্টিসিজমের প্রভাব