রোমান্টিসিজম হল পশ্চিমা বিশ্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা বা আন্দোলনের নাম যা সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, সমালোচনা এবং ইতিহাস-লিখনের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সৃষ্টি করে। সাধারণ ক্লাসিসিজম এবং নব্য ক্লাসিসিজমের নিয়মানুবর্তিতা, সৌষ্ঠব, ভারসাম্য, আদর্শিকতা, স্থিরতা এবং যৌক্তিকতাকে বর্জনের মাধ্যমে রোমান্টিকতার উদ্ভব ঘটেছিল।
ইংরেজি সাহিত্যের গুরত্বপূর্ণ রোমান্টিক লেখক:
জেন অর্স্টেন(Jane Austen):
তিনি আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভাবপ্রধান উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বাস্তবধ্ররমী সাহিত্যে রচনা করেন। পূর্বের সমসত বাঁধা ও শৃঙ্খলাকে অতিক্রম করে তাঁর সাহিত্য রচিত হয়েছে তীক্ষ্ণ প্রহসনে, বাস্তববোধ, হাস্যরস, সামাজিক পর্যালোচনাকে কেন্দ্র করে। তিনি মূলত তাঁর ৬ টি উপন্যাসের জন্য সুপরিচিত। তাঁর উপন্যাসগুলি মূলত আঠারো শতকের শেষভাগে ইংরেজ ভূস্বামীকেন্দ্রিক সমাজকে উপজীব্য করে রচিত।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: ‘Sense and Sensibility(1811)’, ‘Pride and prejudice(1813)’, ‘Northanger Abbey(1817)’, এবং ‘Persuasion(1817)’ ইত্যাদি। তাঁর বেশিরভাগ লখা বেনামে প্রকাশিত হত। পরবর্তীতে অনেক লেখক অর্স্টেনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন: “Charles Dickson, W.M. Thackeray, Anthony Trollope, George Eliot এবং Elizabeth Gaskell.”
উইলিয়াম ব্লেইক(William Blake):
উইলিয়াম ব্লেইককে রোমান্টিক যুগের অগ্রদূত বলা হয়। তাঁর বিখ্যাত বই ‘Poetical Sketches’ প্রকাশিত হয় ১৭৮৩ সালে। ব্লেক ১২ থেকে ২০ বছ্র পর্যন্ত যতগুলো কবিতা লিখেছেন সবগুলোই এই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে ১৭৮৯ সালে বইটিতে ‘Thek’ এবং ‘The songs of ‘Onnocence’ কবিতাগুচ্ছো যুক্ত হয়। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস এবং বৃটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধের যে অস্বস্তিকর অবস্থা তা ব্লেক তাঁর ‘America(1793)’, এবং ‘The Vision of the Daughter of Albion(1793)’ বইয়ে তুলে ধরেন। রোমান্টিক ভাবনার এই কবির অন্যান্যা উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হল: ‘The Marriage of Heaven and Hell’, ‘Europe’ এবং ‘The First book of Urizen’ ইত্যাদি।
ব্লেক রোমান্টিক কবিদের মতই কল্পনার জগতকে বড় করে দেখেছেন। রোমান্টিক কবিদের মতই তিনি তাঁর কবিতায় সবুজ মাঠ, শিশির, বুনো পাখি, গিরি-পর্বত, সবুজ উপত্যকতা, মেঘ তুলে এনেছেন অবলীলাক্রমে। উইলিয়াম ব্লেকের কবিতায় অনুকরণের আভাসও পাওয়া যায়। তিনি শেক্সপিয়র, মিল্টন ও স্পেন্সারের কাব্যরীতি অনুসরণ করতেন।
স্যামুয়েল টেইলার কোলরিজ (Samuel Taylor Coleridge):
ইংরেজি কাব্য-জগতে রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয়দের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। তাঁর সময়ের কাব্যচর্চার বিভিন্ন বিষ্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করার জন্য অনেকটা আত্মজীবনী আকারে গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম ‘Biographical Sketches of my literary life and opinions’ তাঁর এই লেখায় জার্মান দার্শনিকদের প্রভাব রয়েছে। কোলরিজ সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিল তাঁর ‘T Rime of the Ancient Mariner’ এবং ‘Kubla Khan’ কবিতার জন্য।
কোলরিজের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হল : ‘Sonnets on the Eminet charecters(1794)’, ‘Poems on various subject(1795)’, ‘Fears in solitude(1798)’ এবং ‘Nightingale: A conversion poem(1798)’ ইত্যাদি। এমারসন এবং আমেরিকান অতীন্দ্রীয়বাদে তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিল।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
রোমান্টিসিজম কী বা রোমান্টিসিজম কাকে বলে?
রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
রোমান্টিকদের রচনার বিষয়বস্তু আলোচনা করুন
রোমান্টিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
রোমান্টিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
সঙ্গীতের উপর রোমান্টিসিজমের প্রভাব
শিল্প ও চিত্রকলায় রোমান্টিকতার প্রভাব
স্থাপত্যশিল্পে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
উইলিয়াম ওয়ার্ডসয়ার্থ(William Wordsworth):
ওয়ার্ডসয়ার্থ এবং কোলরিজ উভ্য মিলে ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক ধারা সূত্রপাত করেন। ওয়ার্ডসয়ার্থ ছিলেন প্রকৃতির কবি। তাঁর কর্মপ্রচেষ্টার দিকে নজর রেখে সমালোচক্রা তাকে প্রকৃতির ‘মহাকবি’ ও দার্শনিক ‘The highest Priest of Nature’ প্রভূতি অভিধায় অভিহিত করেছেন। ওয়ার্ডসয়ার্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘An evening walk(1793)’, ‘I wandered lonely as a cloud(1807)’। ১৭৯৮ সালে ওয়ার্ডসয়ার্থ ও কোলরিজের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালেড’, রোমান্টিক সাহিত্যর সূচনা করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা বলে বিবেচিত হয় ‘Lucy group of poems’
লর্ড বাইরন(Lord Byron) ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী ও রোমান্টিক কবি বলা হয় বাইরনকে। বাইরন ১৮০৯ এবং ১৮১১ সালে পর্তুগাল, স্পেন, গ্রিস, ও তুর্কি ভ্রমনে যান। সেই ভ্রমন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে রচনা করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Childe Harolds pilgrimage’। বাইরনের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘Don Juan’, ‘She walks in Beauty’, ‘Hours of Idleness’, ‘English Birds and Scotch Reviews’ ইত্যাদি। একজন প্রভাবশালী লেখক হিসেবে তাঁর লেখা সমাকালীন সময়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
জন কীটস(Jhon Keats):
হোর্হে লুইস বোর্হেসের মতে, “কীটস লেখার সাথে প্রথম পরিচ্য, তাঁর সাহিত্যিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তৎকালীন সমালোচকদের মতে, তাঁর লেখা কবিতা খুব একটা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেনি। কীটসের মৃত্যুর পর তাঁর লেখাগুলো সঠিক মূল্যায়ন পেতে শুরু করে এবং ঊনিশ শতকের শেষের দিকে তিনি জনপ্রিয় ইংলিশ কবির মর্যাদা পান। ১৮১৭ সালে ৩০ টি কবিতা ও সনেটের সমন্বয়ে ‘Poem’ শিরোনামে তাঁর বই প্রকাশিত হয়। কীটসের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মাঝে রয়েছে ‘The Eve of st Agned’, ‘La Belle Dame Sans Merci’, ‘Endymion’, ‘To Autumn’ ইত্যাদি।
তাঁর ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত ‘Ode’ এর মধ্যে ‘Ode to a Nigtingale’ অন্যতম। কীটসের একটি বিখ্যাত উক্তি হল-“Beauty is truth, truth is beauty that is all yr know on earth, and all ye need to know”। কীটস দ্বিতীয় প্রজন্মের রোমান্টিক কবিদের একজন বলে বিবেচিত। কাব্য-কবিতা, উপন্যাসের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যে বেশ কয়েকজন রোমান্টিক ধাঁচের গদ্যকারের পরিচিয় পাওয়া যায়। চার্লস ল্যাম্ব, উইলিয়াম হ্যাজলিট, থমাস ডি কুইনিস, থমাস লাঙপিকক মত একঝাঁক বিশিষ্ট্য গদ্যকার এ সময়ের সাহিত্য সম্ভারকে আরও উৎকৃষ্ট করে তুলেছে। নিজস্ব ছন্দে, রীতিতে রোমান্টিক যুগের সাহিত্য সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য রোমান্টিক সাহিত্যিক: পাশ্চাত্য রোমান্টিসিজমের প্রভাব প্রাচ্যের সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছিল/ সাহিত্যের এই ধারার স্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল প্রাচ্যের অনেক সাহিত্যিক।
বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক কবিরা হলেন
বিহারীলাল চক্রবর্তী(১৮৩৫-১৮৯৪):
বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিকবি বলা হয় তাকে। অতি অল্পসময়ের ভিতর তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন করে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। তাঁর কাব্যেই প্রথম ‘Romantic Mlankoly’ র প্রকাশ ঘটে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হল: ‘সারদামঙ্গল(১৮৭৯)’, ‘সাধের আসন(১৮৮৯)’, ‘মায়াদেবী(১৮৮২)’, ‘ধূমকেতু(১৮৮২)’, ‘বাউল বিংশতি(১৮৮৭)’, ইত্যাদি। রোমান্টিক বিষণ্ণতার এক করুণ সুর ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কাব্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১):
বৈষ্ণব পদাবলীর পরে বাঙালি তার রোমান্টিক প্রেমভাবনার বিচিত্র অনুভূতি খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের মাঝে। শ্রীচৈতন্যদেবের পৌরহিত্য ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার জনসমাজের মাঝে যে প্রেমের সঞ্চার ঘটেছিল তার উৎস স্বদেশ হলেও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাংলা সাহিয়ে যে রোমান্টিক প্রেমেরসের সমাবেশ ঘটেছিল তার উৎস ইউরোপে। বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে “জন্ম-রোমান্টিক কবি” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তীব্র কল্পনাপ্রবনতা, সুদূরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, সুক্ষ সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙ্গা আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ভাবনার অন্যতম উৎস। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলো হল: ‘ছবি ও গান(১৮৯০)’, ‘সোনারতরী(১৮৯৪)’, ‘চিত্রা(১৮৯৬)’, ‘পুনশ্চ(১৯৩২)’, ‘জন্মদিনে(১৯৪১)’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ভাবনার প্রকাশ তাঁর যেসব উপন্যাসে ঘটেছিল সেগুলো হল: ‘চোখের বালি(১৯০৩)’, নৌকাডুবি(১৯০৬)’, ‘শেষের কবিতা(১৯২৯)’ ইত্যাদি। সাহিত্য চর্চার প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের অনুসারী ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬):
বাংলা কাব্য সাহিত্যে নজরুল আবির্ভূত হন রোমান্টিক প্লাবনের যুগে। ফলে তিনিও বিবেক বর্জিত আবেগাপ্লুত হতে বাধ্য হন অনেকটা যুগের প্রভাবে। রোমান্টিক ভাবনায় নজরুল বুদ্ধিনির্ভর নয়, হৃদয়নির্ভর কবি।
কবি হিসেবে নজরুল ছিলেন বিরহকাতর, রোমান্টিক ও সুন্দরের পূজারী প্রেমিক। প্রেমিক নজরুলের মান-অভিমান, অনুরাগ-বিরাগ, দ্বন্দ্ব-সংশয়ের অপূরব প্রকাশ ‘দোলন-চাঁপা(১৯২৩)’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রোমান্টিক কাব্য: ‘ সিন্ধু হিন্দোল(১৯২৭)’, ‘চক্রবাক(১৯২৯)’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ও শেলীর মত অতিন্দ্রীয় প্রেমে নজরুল বিশ্বাসী ছিলেন না।
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)
‘রূপসী বাংলার কবি’ বলে খ্যাত এই লেখকের সাহিত্যে রোমান্টিকতা এসেছে অনেকটা প্রকৃতির হাতব ধরেই।বাংলার প্রকৃতি,মাঠ-ঘাট,ধানের শীষ,গোবরে পোকা,সন্ধ্যার আকাশ,বাংলার নদ-নদী,ভোরের শিশির,হেমন্ত ঋতুর রিক্ততা এই সব বিষয়কেই তিনি তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন রোমান্টিকতার আদলে। তাঁর রোমান্টিক ভাবনার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ প্রক্রিতিপ্রেম, নিসঙ্গতা, বেদনা, হাহাকার, রিক্ততা, সৌন্দর্যের প্রতি মোহতা ইত্যাদি।তাঁর রোমান্টিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ হলঃ ঝরা পালক(১৯২৭),রূপসী বাংলা (১৯৫৪), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতাসেন(১৯৩৫) ইত্যাদি।
ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪)
ফররুখ আহমদকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি বলা হয়।বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতার শব্দচয়ন, বাক্প্রতিমা, রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ।রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতার ধারাবাহিকথা পরিস্ফুট হয় তাঁর সাত সাগরের মাঝি(১৯৪৪), সিন্দাবাদ (১৯৮৩), দিলরুবা (১৯৪৪) প্রভৃতি কাব্যে।
এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে শাহ মুহাম্মদ সগীর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,বলেন্দ্রনাথ থাকুর,জসীম উদ্দীনের লেখায় রোমান্টিকতার ছাপ স্পষ্ট।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
রোমান্টিসিজম কী বা রোমান্টিসিজম কাকে বলে?
রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
রোমান্টিকদের রচনার বিষয়বস্তু আলোচনা করুন
রোমান্টিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
রোমান্টিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের প্রভাব
সঙ্গীতের উপর রোমান্টিসিজমের প্রভাব