Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা সাহিত্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ইংরেজি ‘genius’ শব্দে অলৌকিকের যে আভাস আছে, তা স্বীকার্য হলে প্রতিভা এক ধরনের আবেশ। সংস্কৃত ‘প্রতিভা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ অনুসারে তা হবে বুদ্ধিদীপ্ত মেধার নামান্তর। বাংলা কাব্যে সুধীন্দ্রনাথ সেই বুদ্ধিদীপ্ত মেধা। অথচ প্রতিভার প্রাচুর্য নিয়ে সুধীন দত্ত গভীর নিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন কবিতা রচনার কর্মযজ্ঞে। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ, পন্ডিত ও মনস্বী, তীব্র বিশ্লেষণী বুদ্ধির অধিকারী, তত্ত্বে আসক্ত, দর্শনে ও সংলগ্ন শাস্ত্রসমূহে বিদ্বান। তাঁর পঠনের পরিধি ছিল বিরাট এবং বোধের ক্ষিপ্রতা বুদ্ধির সীমা অতিক্রান্ত ও অসামান্য। তাঁর কান্ডজ্ঞান, সাংসারিক ও সামাজিক সুবুদ্ধি, আলাপদক্ষ, রসিক, প্রখর ব্যক্তিত্বশালী পরিপূর্ণ মনীষা সবকিছুই হয়েছে কবিত্বের অনুষঙ্গ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – এই সময়কালেই সুধীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল: ‘তন্বী’ (১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৯), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩), ‘প্রতিধ্বনি’ (ফরাসি ও জার্মান কবিতার অনুবাদ, ১৯৫৪) ও ‘দশমী’ (১৯৫৬)।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা মূলত এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ; নিরন্তর সংগ্রাম-ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল এবং ধ্বনিমাধুর্যের। ‘শ্রীশ্রী দুর্গামাতা সহায়’ বলে অসাধারণ নিষ্ঠা নিয়ে তিনি কাব্য রচনা আরম্ভ করেন। বুদ্ধি দ্বারা আদিষ্ট পরিশ্রমী সুধীন দত্ত অতি ধীরে সাহিত্যের পথে অগ্রসর হলেন সুচিন্তিতভাবে, গভীরতম শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের মতো সুধীন দত্ত কবি হয়ে ওঠেন অস্বাভাবিক পথে। অগ্রজদের শিথিল ও অতিভাষী বাংলা কবিতাকে অভাবনীয় সংহতি ও দার্ঢ্য প্রদান তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব। মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্য, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আর সুধীন দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’ বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিষয় ও বিন্যাসে দিয়েছে নতুনত্বের সন্ধান। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু জীবনের মৌল সত্য প্রেম, কাল, ভগবান প্রভৃতির অনুসন্ধান।

সুধীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও আমেরিকা সফর করেন, পরে একা ইউরোপ ভ্রমণে যান। সারা বছরের এই বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর কাব্যের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায় আরম্ভ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত তাঁর অপর সীমানা। ১৯৩০-৪০; এই দশ বছর তাঁর অধিকাংশ প্রধান রচনার জন্মকাল। প্রায় সমগ্র ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৭), ‘উত্তর ফাল্গুনী'(১৯৪০), প্রায় সমগ্র সংবর্ত (১৯৫৩), সমগ্র কাব্য ও গদ্য ‘স্বগত’, ‘কুলায় ও কাল পুরুষে’র প্রবন্ধাবলি – এই একটি মাত্র দশকের মধ্যে তিনি সমাপ্ত করেন। তাঁর সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকার সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল পর্যায়, ১৯৩১-৩৬ তাও এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহিতলাল মজুমদার – এই তিনজন কবির ঠান্ডা উপস্থিতি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কাব্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। উনিশ শতকী মনোপ্রসাদে ধনী, মহাকবি মাইকেলের কবিতা বর্ণনাধর্মী। অন্যপক্ষে সুধীন দত্তের কবিতা সময় স্বভাবের প্রভাবে ব্যঞ্জনাবীথি ছড়ানো এবং ভবঘুরে গীতিকবিতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তবু দুই দত্তজ কবির মধ্যে কিছু ঐক্য রয়েছে:

এক. বহিরঙ্গে কঠিন, সংবৃত, সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারে, যত্নকৃত যতিচিহ্নের উপস্থাপন ও গঠনের নিবিড় জ্যামিতিতে।

দুই. অন্তরঙ্গে – দুজনই আত্মজড়িত, মানসিক জর্জরিত দ্বৈরথ সমরে দুই বিক্ষুব্ধ সন্তান, এক অপ্রতিকার্য নিয়ত চৈতন্যের পুত্র;

ব্যক্তিজীবনে পার্থক্য আছে, কিন্তু মনোজীবনে সন্দেহ আর সংরাগে অনন্য। সুধীন দত্ত আধুনিক কুশল মানুষের মতোই ভদ্রলোকিত্বের ইস্ত্রিকরা পোশাকের তলায় প্রাণপণে ঢেকে রাখতেন অন্তর্জগৎ। কবির সন্দেহ, অসুখ, বিবেক, অপ্রেম, চিৎকার, স্মৃতিকষ্ট আর সর্বোপরি লোকোত্তর তাড়না; যার দেহ থেকে রবীন্দ্রনাথের মতো ঈশ্বরকে উচ্ছিন্ন করা যায় না। অন্তর্জগৎ জুড়ে লুকিয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। ঈশ্বর থেকেই যান কবির চৈতন্যের অলিগলির বিপদ আপদে। মাইকেলের ‘প্রাক্তন’ই সুধীন দত্তের গুরুতর ‘ভবিতব্য’। সুধীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রছায়ায় লালিত মানুষ। স্বাভাবিকভাবে তাঁর প্রভাব থাকবেই। প্রথম প্রথম অনুকরণও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সুধীন দত্তের মনোভাব ও গঠনের ক্ল্যাসিক ঐতিহ্যের অন্তরালে রোমান্টিক উজ্জীবনের স্বতঃপ্রকাশ। তাঁর কাব্যে সারাজীবন ব্যক্তিগত তমসা ও আভার উচ্চারণ ও চিৎকার রোমান্টিকতারই বংশলক্ষণ।

কবি মোহিতলাল মজুমদারের কিছু পরোক্ষ প্রভাব আছে সুধীন দত্তে। যা দেখা যায় শব্দ ব্যবহারে, বাক্যগঠনে, বুদ্ধিবাদে, দেহধর্মিতায় ও কাব্যদর্শনের স্বরূপের আরোপে। তবে কবির বুদ্ধিবাদ, দেহধর্ম ও কাব্যদর্শনের স্বরূপের আরোপ মোহিতলাল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোহিতলাল অর্থে তিনি দেহবাদী নন; গভীরভাবে তিনি আধ্যাত্মিক। হয়তো ‘বৈনাশিক কালে’র দুই কালো হাত থেকে সাময়িক উদ্ধার পাওয়ার জন্য দেহের আশ্রয়ে শান্তি ও মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন মাত্র। তাঁর দেহসম্ভোগ স্মৃতির ভেতর দিয়ে রচিত। মোহিতলালের দেহধর্মের আস্থা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াজাত। স্বদেশের বাইরে সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘মালার্মে’র ভীষণ ভক্ত ও অনুরাগী। মালার্মে ছাড়াও তাঁর দুই স্বনামধন্য শিষ্য ‘পোলভালেরি’ ও ‘মার্সেল প্রস্তে’র সঙ্গে সুধীন বাবুর কাব্যসখ্য ছিল। বিশেষ করে ‘মালার্মে’র শিষ্য পোলভালেরির সঙ্গে সুধীন দত্তের ঐক্য পরিলক্ষিত।

এই ঐক্য রোমান্টিক মনোবৃত্তি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট অবজ্ঞা, নিরুত্তেজ আবেগ, ক্ল্যাসিক বৈদগ্ধ্য, চৈতন্যের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস ও নৈরাশ্যকে সম্ভ্রান্ত সাহসে গ্রহণের মধ্যে। ‘ধ্রুবপদ’ গঠনে ফরাসি কবিতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ লক্ষণীয়। তবে সুধীন দত্তে রোমান্টিক অবজ্ঞার অন্তরালে রোমান্টিক আকর্ষণই প্রকাশিত :

“একটি কথার দ্বিধা থর থর ছুড়ে ভর করেছিলে সাতটি অমরাবতী; একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,

থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;” (শাশ্বতী’, অর্কেস্ট্রা)

১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘অর্কেস্ট্রা’ সুধীন দত্তের পূর্ণাঙ্গ আকারে বহুলাঙ্গে পরিণত কাব্য। অর্কেস্ট্রা প্রেমবিরহের কাব্য। কিন্তু এ প্রেম ও বিরহের সঙ্গে বাংলা কাব্যের চিরাচরিত ধারার ব্যবধান বিরাট। পুরনো অথচ চিরনতুন প্রেমের বিষয়কে তিনি সম্পূর্ণ নতুন মূল্যবোধে উপস্থাপন করে বাংলা সাহিত্যে প্রেমবিরহের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন, যার প্রকাশ অপূর্ব ও অনন্য। আধুনিক প্রেমের অবিশ্বাস, সন্দেহ, ছলনার মায়াজাল এবং ক্ষণবাদিতার এক অনন্য প্রকাশ হয়ে উঠল তাঁর কবিতা। রবীন্দ্রনাথের সুখদা, কল্যাণী, শাশ্বতীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম কবিতাতেই দাঁড় করালেন নিজস্ব নায়িকা ‘ক্ষণিকা’কে। এখানে পাঠক তাঁর ক্ষণিক, রঙিন, আধুনিক প্রেমের সঙ্গে পরিচিত হলো –

“মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে

স্থান পাবে হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার :

বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার;

আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে।” (‘হৈমন্তী’, অর্কেস্ট্রা)

এ-কাব্যগ্রন্থেই প্রথম দেখা গেল আধুনিক প্রেম ও তার বহুস্তর দ্বন্দ্বপীড়িত আত্মা। ক্ষণিকতা, প্রেমের অপ্রিয় সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান ও স্পষ্ট কথন –

“অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ;

অসংগত চির প্রেম; সংবরণ অসাধ্য অন্যায়;” (‘মহাসত্য’, অর্কেস্ট্রা)

কবির প্রেমিকও একদিন চলে যাবে অপরের কাছে ‘কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।’ মর্মান্তিক এ সত্য কবি জানেন, এজন্য কবির মতো দুঃখী কেউ নেই। কবির প্রেয়সী তো আধুনিকা : সে পূর্বে ছিল অন্য কারো প্রেমিকা, ভবিষ্যতেও সে অপরের হৃদয়াসনে বিরাজ করবে; শুধু মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে সে ও কবি ভরে উঠেছিল ভালোবাসায় –

“ভেবো না, ভেবো না, সখী; স্বপ্ন দুঃস্থ দীর্ঘ রাত্রি শেষে

বসন্ত অন্তরে তব আরম্ভিবে পুন চতুরালি :

নবীন ফাল্গুনী আসি হানা দিবে রুদ্ধদ্বার দেশে; ফলিবে মানস ক্ষেত্রে বর্ষে বর্ষে সোনার চৈতালি।

ক্ষণিক ইন্দ্ৰত্ব লভি অনায়াস তপস্যার ফলে,

তোমার উরস স্বর্গে বিরাজিবে বহু মর্ত্যচর,” (‘ভবিতব্য’, অর্কেস্ট্রা)

‘অর্কেস্ট্রা’র ‘সঞ্চয়’,’ সর্বনাশ’ কবিতায় ব্যক্ত প্রিয়তমার অতীতের কথা; ‘ভবিতব্য’, ‘শাশ্বতী’ ইত্যাদিতে তাঁর ভবিষ্যতের চিত্র। কবির কাছে অতীত অন্ধকার, ভবিষ্যৎ মৃত। প্রেমের বহুস্তর মনোভাবের ফলেই প্রিয়াকে কবির কখনো মনে হয় ‘ছলনাময়ী’, কখনো ‘প্রলুব্ধ ছায়াময়ী’। কবি-প্রেমিকার অতীত ও ভবিষ্যৎ জীবন কোনোটাই কবির পক্ষে সুখের নয়, আবার একমাত্র বর্তমানও অপাপবিদ্ধ নয় –

‘জানি অলজ্জিত রাতে, শ্লথনীবি কম্প্র আত্মদানে

দেয়নি সে মোরে অর্ঘ্য, খুঁজেছিল বসন্ত সখাকে।’ (‘জিজ্ঞাসা’, অর্কেস্ট্রা)

স্মৃতির ভেতর বর্তমানও অকপট ভালোবাসায় ভরা নয়। এ মর্মান্তিক রূঢ় ও বদমাশসত্যকে যিনি জানেন, তিনি দার্শনিক বটে; কিন্তু তাঁর পক্ষে শান্তি দুরাশারই নামান্তর। মূলকথা- যার চোখ মঞ্জুল প্রতিমা ভেদ করে ভেতরে কাঠখড় আবর্জনা দেখতে পায়, মোহিনী নারীর ভেতর দেখে শুধু কঙ্কাল, তিনি অসুখী। সত্যের উপরিস্তর তাকে ভোলাতে অসমর্থ। সুধীন্দ্রনাথের কবিদৃষ্টির রঞ্জনরশ্মি এক নিরুত্তর সত্যের মর্মে গিয়ে বিঁধে। তবু বর্তমানতায় মগ্ন ক্ষণিকাকে উদ্দেশ করে বলেন-

“চাই চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই 

উল্লম্ফন রভসে নামে অনন্তের উন্মুদ্র অতলে।

কণিকাও নহি আমি; চরাচর লুপ্ত সে কল্লোলে।” (‘লঘিমা’, ক্রন্দসী)।

ঈশ্বর চেতনা মূর্ত হলো ‘প্রশ্ন’, ‘প্রার্থনা’ ইত্যাদি কবিতায় –

“ভগবান ভগবান, রিক্ত নাম তুমি কি কেবলই? নেই তুমি যথার্থ কি নেই?

তুমি কি সত্যই

আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপ্ন।”(‘প্রশ্ন’, ক্রন্দসী)

মৃত্যু সম্পর্কে কবি বলেন-

“মৃত্যুর সৈকতে

মহত্ত্ব কল্পনা মাত্র। বল্মীকের সাম্যময় স্তুপে নির্লিপ্ত নির্বাণ, শান্তি কেবলই স্বপন।”(‘মৃত্যু’, ক্রন্দসী)

‘সৃষ্টির রহস্য’ কবিতাতেও কবির দার্শনিক প্রতীতি বাঙ্ময় –

“কপোল কল্পনা ত্যাগ, নিরাসক্তি অসাধ্য সাধন;

অনন্ত প্রস্থান মিথ্যা; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা;

বিদ্রোহে স্বতন্ত্র্য্য নাই; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা;

সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন।”

“উত্তর ফাল্গুনী” ১৯৪০ সালে প্রকাশিত। এটা ‘ক্রন্দসী’র পরিপূরক কাব্যগ্রন্থ। এখানে প্রেম ফিরে এলো বহুস্তর আধুনিকতায় ভরপুর উৎসুক ও গভীর হয়ে। এখানে সাধারণী প্রেমিকার মধ্যে জেগে ওঠে চিরন্তনী। তখন কবির ক্ষমাহীন মৌল জিজ্ঞাসা,

‘ভালো কি তবে বেসেছি তারে আমি

বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?”

ওই জাগর চৈতন্যই কবিকে ঘুমের ভেতরেও নিদ্রাহীন করে দিয়ে যায়। ‘প্রতিদানে’ প্রেমের আশা-নিরাশা উভয়ই আছে :

“আমার মনের আদিম আঁধারে

বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে

প্রাকপুরাণিক বিকট পশুর

দায় ভাগ মোর শোনিতে নাচে।” (‘প্রতিদান’, উত্তর ফাল্গুনী)

‘ব্যবধান’, ‘অহৈতুকী’, ‘নিরুক্তি’ ইত্যাদি কবিতায় প্রায় অনুরূপ মনোভাব ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ‘প্রতিপদ’ কবিতায় ‘আত্মহারা স্বয়ং সবিতা’।

অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সংবর্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। কাব্যের মুখবন্ধে কবি লিখেছেন-

‘মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট। আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ; এবং উপস্থিত রচনাসমূহ শব্দ প্রয়োগের পরীক্ষা রূপেই বিবেচ্য।’

সংবর্তে প্রবেশ করল তপ্ত ও স্পন্দিত সমকাল তাঁর ভাস্কর্যের অবয়বে। এখানে প্রেয়সী, প্রকৃতি ও রাজনীতি একাকার হয়েছে – এলোমেলো জীবনের বিন্যাসে নির্মাণে, পুনর্বিন্যাসে পুনর্নিমাণে। ‘নান্দীমুখ’ কবিতায় তার উদ্বোধন, বিন্যাস ‘উপসংহার’ কবিতায় :

“হেথা নাস্তি পৃষ্ঠে, পুরো ভাগে :

মাঝে শুধু তুমি, আমি আর এ আদিম অরণ্যানি;

সমাধিনিমগ্নকাল, অসম্ভূত অমা একা জাগে, পরাহত লুব্ধ কানাকানি।” (‘উপসংহার’, সংবর্ত )

এখানে ওই ‘অরণ্য’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় উন্মুক্ত আতিশয্যের নগর সভ্যতা। যাতে দেখা যায় নিরঙ্কুশ, নিঃসন্তান নিত্য মরুভূমি আসিত্মকের পুরস্কার, তরণী শতচ্ছি; কাস্তে হলো চাঁদ; অরাজক চরাচরে প্রশ্ন প্রতিহিংসার প্রতুল এবং ‘জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত অতীন্দ্রিয় ভাবনানিচয়’। আধুনিক যুগের স্বাক্ষর মুদ্রিত এর পাতায় পাতায়। 

তাঁর কাব্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক নারকীয় মনোভাব ভনভন করে ঘোরে, টানটান করে রাখে একই মানদণ্ড। বাংলা কাব্যে তিনি নৈরাশ্যবাদের আত্মার সন্তান। তাঁর কাব্যাদর্শে অন্বিষ্ট ধ্রম্নপদী শিল্পীর নিষ্ঠা, প্রতীকী কবিদের স্বল্পভাষ ব্যঞ্জনাধর্মী সংহতি, ইন্দ্রিয়ঘনত্ব, নৈর্ব্যক্তিকতা, অভিজ্ঞতা ও অধ্যবসায়। সুধীন দত্ত জড়বাদী ও ক্ষণবাদী দর্শনের অভিব্যক্তির অন্তরালে আধুনিক দার্ঢ্য, অভিজাত কাব্যভাষার উদ্ভাবক। স্বদেশ-বিদেশের কোনো কোনো কবির সঙ্গে কাব্য নির্মাণে ও কাব্যভাষায় সংযুক্ত হলেও তিনি সেসব কবির আপাত ও লুকানো প্রভাব ছাড়িয়ে আপন মৌলিকতাকে করেছেন সুস্পষ্ট। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র, একাকী ও উত্তর সাধকের বিস্ময়স্থল। ‘কবি’ শব্দের প্রতিটি অর্থ সুধীন্দ্রনাথের জীবন ও রচনায় প্রমূর্ত।

গ্রন্থসূত্র

১. কালের পুতুল, বুদ্ধদেব বসু।

২. আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব।

৩. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী।

৪. দশদিগন্তের দ্রষ্টা, আবদুল মান্নান সৈয়দ।

৫. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কাব্য সংগ্রহ, দে’জ পাবলিশার্স, কলকাতা।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কমরুদ্দিন আহমদ

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.