রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম পথিকৃত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) যেন এক নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। ব্যক্তিগত অনুভূতি তাঁর কবিতায় বিশ্ববেদনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে। যদিও তিনি ‘জনতার জঘন্য মিতালি’তে চিরকাল জুগুপ্সা বোধ করেছেন, তবু তিনি জীবনানন্দের মতো আত্মনিমগ্ন নির্জনতার কবি ছিলেন না, কারণ তিনি জানতেন, সভ্যতার বাইরে ব্যক্তিসত্ত্বার কোনো অস্তিত্ব বা মুক্তি নেই। তাঁর কাব্যসম্ভার যেন এক হতাশ বন্ধ্য নায়কের হাহাকার। সভ্যতার মর্মস্থলেই সেই হাহাকারের উৎস।
গ্যেটের মানবতাবাদ ও মঙ্গলধর্মে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেমন বোদলেয়রের নারকীয় আবির্ভাব, তেমনি রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্ব ও শুভবাদের বিরুদ্ধে সুধীন্দ্রনাথের নেতিবাদ ও শূন্যবাদী ঘোষণা জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী…
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – এই সময়কালেই সুধীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল: ‘তন্বী’ (১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৯), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩), ‘প্রতিধ্বনি’ (ফরাসি ও জার্মান কবিতার অনুবাদ, ১৯৫৪) ও ‘দশমী’ (১৯৫৬)।
সুধীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্য ‘তন্বী’ উৎসর্গিত হয় রবীন্দ্রনাথের শ্রীচরণে সেখানে কবি বলেছেন, ঋণ শোধের জন্য নয়, ঋণ স্বীকারের জন্য’। এ ঋণ সুধীন্দ্রনাথের কবি চৈতন্যের উৎসারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের গ্লানি ও বিষণ্নতাক্লিষ্ট। তাঁর দুঃখবাদী, ক্ষণবাদী চেতনা অস্ফুটে স্তিমিত হয়ে আছে ‘বর্ষার দিনে’, ‘পলাতকা’ প্রভৃতি কবিতায়।
‘তন্ত্রী’তে যে ইন্দ্রিয়-ভারাতুর প্রেম চেতনার যে অলক্ষ্য আবেগ আমরা দেখেছি ‘অর্কেস্ট্রা’তে তা অনেক বেশি পরিণত ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ – সে অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে আছে এক নামহারা বিদেশিনী – যে সঙ্গহীন বিজন প্রবাসে জীবনের এক সংকটকালে দেহ-মনে পর্যুদস্ত কবিকে দিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক শুশ্রূষা, আসঙ্গ আশ্রয় ও প্রশ্রয়। কবির কৃতজ্ঞতা প্রসূত উক্তি – ‘সে সেবার নেই প্রতিদান’। ‘অর্কেস্ট্রা’র ভূমিকায় কবি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত মণীষার জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের পরম সার্থকতা।’ তাই তাঁর নিঃসঙ্গ নায়কের আর্তনাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী রৌরবের আর্তনাদ শুনতে পাই। ক্ষণিকের অচরিতার্থ প্রেম স্থায়ী হবে না জেনেও ভালবাসাকেই শরীরী মুদ্রায় ধারণ করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়েছেন।
‘ক্রন্দসী’ পর্বে এসে কবি ‘বিলাপ বিহ্বলতা’ ও ‘কৃপাজীবী ক্লীবের ক্রন্দন’ পরিহার করেছেন। নিরন্তর আত্মানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে নির্দ্বন্ধ কবি বলেছেন-
আমি যারে চাই
তার মাঝে ভেদ নাই, দ্বন্দ্ব নাই,
দেশ কাল নাই…..
কৃষ্ণপরবশ অর্জুনের পরিবর্তে মর্মদর্শী সঞ্জয়ের স্বাবলম্বিতাই তাঁর অভিপ্রেত। কারণ-
স্থিতধী সঞ্জয়
ডরায় না ব্যাধি, মৃত্যু, জরা।
নচিকেতার প্রেক্ষিতে নিজেকে স্থাপন করে কবি বসুন্ধরার প্রীতি প্রকাশ করেছেন –
দাঁড়ায়ে সে নির্বাণের নির্লিপ্ত কিনারে
নিরুদ্দেশ নচিকেতা দেখেছিল অর্ধমুখে চাহি
সম্ভোগ রাত্রির শেষে ফেনিল সাগরে অবগাহি
শোষিত কাঞ্চনকান্তি নগ্ন বসুন্ধরা।
হতাশা থেকে উৎক্রান্তি অর্জনের অপর নিদর্শন ‘পারাবত’ কবিতায় গ্রিক পুরাণের প্রসঙ্গ।
প্রৌঢ় সভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে কবির প্রৌঢ় নায়ক যৌবনের সমস্ত জ্বালা বুকে নিয়ে বন্ধ্যা বিষাদে আত্মবীক্ষায় মগ্ন থেকেছেন ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে। ক্ষণিকার নির্ভার মৃদু আলাপনের ভঙ্গিতে অচরিতার্থ। প্রেমের নিরুদ্বেগ প্রকাশ –
আমারে তুমি ভালোবাসো না বলে
দুঃখ আমি অবশ্যই পাই;
কিন্তু তাতে বিষাদ শুধু আছেম
তাছাড়া কোনো যাতনা জ্বালা নাই….
বারবার বিশ্বাসের বিনাশ সত্ত্বেও সুধীন্দ্রনাথ আশা করেছিলেন, যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকে ভালবাসা ও বিশ্বাসের সেই পুরাণ-কথিত ফিনিক্স আবার জন্ম নেবে। কিন্তু ‘সংবর্ত’-এ এসে কবির সে বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ‘১৯৪৫’ কবিতায় দেখি-
এরই আয়োজন অর্ধ-শতক ধরে
দু-দুটো যুদ্ধ একাধিক বিপ্লবে;
কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে,
মেদিনী মুখর একনায়কের স্তবে।
সভ্যতা সচেতন মানুষ সভ্যতার বিনষ্টি দেখে নিঃসঙ্গ একাকী বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’ – এই একাকিত্ব, এই নিঃসঙ্গতা ইতিহাসের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত হয়েছে। নিয়তিবাদী মানুষ আজ শূন্যতার উত্তরাধিকার নিয়ে ‘এক রুদ্ধশ্বাস দুঃসহ বেদনাবোধে আক্রান্ত। সভ্যতার শিয়রে নির্বাক বিবেকের মতো দাঁড়িয়ে বেদনার্ত যিশুর উদ্দেশ্যে কবি জিজ্ঞাসা করেছেন –
এই পরিণামের লোভে কি
জন্মালে নারীর গর্ভে, আত্মবলি দিলে নরমেধে ….
‘প্রতিধ্বনি’ পঞ্চান্নটি অনুবাদ কবিতার সংকলন। ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান – এই তিন ভাষায় লেখা এগারোজন কবির অনুবাদে সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থ।
‘দশমী’তে সুধীন্দ্ৰনাথ যতখানি তাত্ত্বিক, ততখানি কবি নন। এখানে তিনি নাস্তিক্য জগতের বাসিন্দা। যে বস্তুনিষ্ঠা থাকলে বিশ্বসংকটকে মূর্ত করে তোলা যায়, কবি যেন তাতে উদাসীন। তাই দেখা যায় ‘বিরূপ বিশ্বে নিয়ত একাকী’ কবি এ কাব্যে শূন্যতা ও নৈরাশ্য থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় অনেক ধ্রুপদি লক্ষণ নজরে আসে। ভাষার সঙ্গত শাসনকে তিনি মান্য করে বলেছেন, ‘আমার আনন্দ বাক্যে’; তাঁর কবিতা তৎসম শব্দের বাহুল্যে সংহত নিবিড়। এই ইতিহাস- সচেতন কবি ছন্দে ছাড়া লেখেননি। কিন্তু সময়ের তাড়নাতেই এই নিঃসঙ্গ মানুষের কবিতা আদতে রোম্যান্টিক। ‘বাঁশির বর্বর কান্না, মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাসে’ মুখর। আসলে প্রেমই সুধীন্দ্রনাথের কবিতার প্রধান অবলম্বন – তাঁর বিশ্ববীক্ষাও ব্যক্তিগত প্রেমের কাছে বিধৃত। তাঁর কম-বেশি সব কবিতাই যেন রাইনতীরবাসিনী সেই বিদেশিনীর উদ্দেশ্যে সমর্পিত। শেষ পর্যন্ত তারই কথা – সেই দয়িতার – ‘এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে’ –
সে এখনও বেচে আছে কিনা
তা সুদ্ধ জানি না।
– এ কাব্যসৌধ যেন শব্দে রচিত এক প্রেমের স্মৃতিসৌধ।