বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান: কবি নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যের সেই যুগের প্রতিভূ, যখন বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিরা এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। সে-সমস্যাটা আর কিছুই নয়, কী করে রবীন্দ্রপ্রভাব এড়িয়ে কবিতা লেখা যায় এবং বাস্তবোজ্জীব সমস্তাকে কাব্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা।
প্রাক-রবীন্দ্রিক কাব্যাদর্শে আগেই তামাদির নোটিশ জারি হয়ে গেছে। কবিগুরুর প্রভাব বাংলা দেশের সার্বিক শিল্প সাধনার ওপর যে কতখানি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং বাঙলার কাব্য সাধনা যদি দীর্ঘকাল তার প্রভাবচ্ছায়ায় লালিত হয়ে থাকে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, স্বাধীনভাবে কিছু নতুন সৃষ্টি করতে গেলেই অনিবার্যভাবে কায়াহীন রবীন্দ্রনাথ এসে পড়ছেন। স্বনির্ভর হবার স্বার্থে সেই মহৎ আশ্রয় থেকে মুক্ত হবার প্রয়োজন দেখা দিল। বিশেষ করে যখন কয়েকজন কবি যেমন করুণানিধান, কিরণধন, কুমুদরঞ্জন, যতীন বাগচী, কালিদাস রায়, সত্যেন দত্ত প্রভৃতি নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে গিয়ে রবীন্দ্র-চুম্বকের সংলগ্ন হয়ে রবীন্দ্র-কাব্যের অগভীর রীতি-নীতির অনুকরণকারী হয়ে পড়লেন, তখন তরুণ উদ্যোগাদের সমস্তটা রীতিমত ভাবিয়ে তুলল। রবীন্দ্রনাথ যে-পথে নামেননি, সেই পথে নেমে বাংলা কাব্যের উপকরণ খুঁজতে হবে—সে-পথ ক্ষুদ্র হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু বৈশিষ্ট্যযুক্ত হোক। তবেই রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতা লেখা চলতে পারে, নইলে কবিতা হবে রবীন্দ্র প্রভাবের অক্ষম অনুকরণ। পথ নবীন কবিদের সামনে খোলাই ছিল—প্রথম মহাযুদ্ধের অবগুস্তাবী আঘাতে একদিকে দুনিয়াব্যাপী আর্থিক মন্দার আগুনে মধ্যবিত্তের আগ্নিকালের সাজানো বাগান পুড়তে আরম্ভ করল। ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনার রঙীন গোলাপী স্বপ্ন-সৌধ পথের ধুলোয় তাদের খেলাঘরের মতো ভেঙে পড়তে লাগল, অন্তদিকে মহাযুদ্ধ আমাদের যুক্ত করে দিল বিশ্বজীবনের সঙ্গে আর আত্মীয় সম্পর্ক পাতিয়ে দিলেন ১৯১২তে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবের সঙ্গে। রাশিয়ার মেহনতী মানুষের অধিকারের লড়াই জয়যুক্ত হয়েছে, সামন্ততান্ত্রিক দুনিয়ার মালিকানার কায়েম স্বার্থে চিড় ধরেছে। ভারতবর্ষে এই শুভসংবাদ প্রত্যেকের কানে পৌঁছেছে। তখন ভারতবর্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বর হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে, কুখ্যাত রাউলাট আইন জারি হয়েছে, ইংরেজ শাসক অমানুষিক অত্যাচার চালাচ্ছে। তাই বিদেশী শাসন থেকে ভারতের মুক্তি, বুর্জোয়া সমাজ-ব্যবস্থার রক্ত শোষণ থেকে নিজেদের মুক্তি ভারতের জন-হৃদয়কে তখন উদ্বেল করে তুলেছে। গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেছেন। সাহিত্যে তখনও কেউই আসেননি—সাহিত্য চিরকাল মানুষের সংগ্রামে প্রেরণা ও উদ্দীপনা যুগিয়েছে। ইতিপূর্বে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ, বিপিন পালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একযোগে এগিয়ে এসেছিলেন। দ্বিতীয় দশকের আন্দোলনে তিনি এগিয়ে আসেননি—তিনি যে বিশ্বমৈত্রীর স্বপ্ন মনে মনে এঁকেছিলেন, সে স্বপ্ন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে ভেঙে গিয়ে ভারত আবার কূপ-মণ্ডুকতায় পরিণত হবে—এই চিন্তায় তাঁর বিশাল উদার মহৎ মন শিউরে উঠল। আন্দোলনে নামতে প্রাণ থেকে যখন তিনি তাগিদ পেলেন না, তখন তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী স্থাপনের মধ্য দিয়ে নিজের কাঙ্খিত স্বপ্নকে মূর্ত করে তোলার কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করলেন। বাঙালী তখন উন্মুখ হয়ে রয়েছে সাহিত্যিকের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার জন্য। স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে বহু প্রাণমাতানো গান ও কবিতা পেয়েছিল বলে তাঁর কাছ থেকে সেদিন আশা করাটা আমাদের অন্তায় ছিল না। এই আলো-আঁধারে জড়ানো এক বিচিত্র নবারুণের ছাতিকে তখন তরুণ কবিরা না পারছিলেন স্বাগত জানিয়ে দুঃসাহসিক পথে এগুতে, না পারছিলেন সেই পুরোনো অনড় নির্জীব অচলায়তনের বদ্ধ কারাগারে ফিরে গিয়ে নবজীবনের অভিসারকে ভুলতে। মন তখন দোলকের মতো এপাশ-ওপাশ দুলছে।
অবস্থাটা যখন এই রকম চলছে, তখনি নজরুল ইসলাম পুরোনো জীবনের সরকটা অঙ্গুলিবন্ধ জানালা খুলে বাইরের নতুন হাওয়াকে ঘরের মধ্যে ঝড়ের মতো এনে ফেললেন। বাঙালী-প্রাণের বহুদিনের সঞ্চিত জড়তা, সংস্কার ও মানি ঝড়ের মুখে খড়-কুটোর মতো উড়ে গেল। অনেক কালের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সংকল্প তাঁর কবিতায় ঘোষিত হল। তরুণ কবিদের মনোজগতে নতুন গ্রন্থের প্রথম পাতা তিনি খুলে দিলেন, রবীন্দ্র-কাব্যের প্রভাব ধারা এড়াতে চাইছিলেন, সত্যেন দত্তের কাব্যরীতির অন্তঃসারশূন্য উদ্দীপনাহীন ছন্দের কসরত তাদের একঘেঁয়ে লাগছিল। নজরুল ইসলামের কবিতা যেন তাদের চোখের সামনে নতুন দিনের রঙীন আলোর আশার প্রদীপ জ্বেলে দিল।
নজরুলের সাহচর্য ছাড়া মুক্ত বেপরোয়া যৌবনের প্রাণখোলা ভাষা সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি—রবীন্দ্রনাথের যৌবন বের্গসের গতিবাদের সঙ্গে আত্মার ক্রমবিকাশবাদের সংমিশ্রণে তত্ত্বমূলক, সত্যেন দত্তের বন্ধনহীন যৌবনের উত্তাল উদ্দামতা ছিল না, মোহিতলালের যতটুকু ছিল, তাও মানসিক গাম্ভীর্যে উদ্দীপনামূলক, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মধ্যে যৌবন ছিল সৌখীন বিতৃষ্ণাবাদের অবিশ্বাসের বেড়া দিয়ে ঘেরা। নির্বাধ উদ্দীপনাহীন বেহিসেবী জীবন-কল্লোলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নজরুলের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর অব্যবহিত আঘাতের শক্তিতে তৎকালীন যুবক ও কিশোর কবি তার থেকেই নতুন কাব্যের ইঙ্গিত পাবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। তাই আজও রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিদের মধ্যে তাকেই উজ্জ্বলতম সেতু বলে নির্দেশ করতে আমাদের একমুহূর্ত দেরী হয় না।
নজরুলের কাছ থেকে শুধু এটুকুই কি আমরা পেয়েছিলাম? না, পেয়েছিলাম এই আশ্বাস যে, উচ্ছ্বাস, আবেগ-কল্পনার জগৎ থেকে সাংসারিক সমতলে কবিতা নেমেও সে জাতিভ্রষ্ট হয় না। জীবনের রূঢ় বাস্তব কবিতার মধ্যে আসতেই কাব্য-বিচারে সমাজ সচেতনতার মানদণ্ড প্রয়োগ করা আরম্ভ হল। কবিতা যে জীবন-সংগ্রামের গতিয়ার হতে পারে, সে ধারণা বাংলাদেশের কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হল, আর তিনিই দেখিয়ে দিলেন কবিতা এবং জীবনকে, সংগ্রাম এবং আদর্শকে কীভাবে একাত্ম করে তুলতে হয়। যখন তাঁর কবিতা অসামান্য লোকপ্রিয়তা অর্জন করল, তখন তাঁর নতুনতর কাব্যদর্শনকে সচেতন কলারসিকের মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইল না। পেয়েছিলাম আর একটি উদাহরণ, যিনি আধুনিক যুব-মনের নানা অস্বাস্থ্যকর আচারের বন্ধন মাকড়সার জালের মতো ছিন্ন করে পচা সমাজ-ব্যবস্থা উৎখাত করতে, পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করতে অতিশয় দৃপ্ত ও অধীর ছন্দে নওজোয়ানদের আহ্বান করেছেন, বিদেশী সরকার তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে এবং তাঁর একাধিক বইয়ের প্রকাশ ও প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে—বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত এর উদাহরণ অপ্রতুল।
আর কি কিছুই পাইনি? আরো কিছু পেয়েছি। প্রথমতঃ, বক্তৃতাধর্মী যুক্তি-তর্কের ফাঁকে, গন্তব্যধর্মী কথার মাঝে হঠাৎ এক-একটি লুব্ধ করা, মুগ্ধ করা আলোময় উজ্জ্বল পংক্তি, যেমন—
: রং করা ঐ চামড়ার মত আবরণ খুলে নাও। (কুলিমজুর—সাম্যবাদী : সর্বহারা) : আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের আপ— : আঁখির ঝিমুকে সঞ্চিত থাক যত অশ্রুর ব্যথা। (করিয়ান : সর্বহারা) : জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চা : সর্বহারা) : রোদের উমুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গত না। : গগন-লোকে আকাশ-বধূর সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলত না। (সান্ত্বনা চিত্তনামা)
তাঁর সাহিত্যে খুব বেশী নেই বলেই তাদের মনোহারিত্ব যেন আরও বেশি। দ্বিতীয়তঃ, একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী—এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন থেকে ভিন্ন এ অর্থে বলছি। রবীন্দ্রনাথের অধ্যায় লোকোত্তরণ, অবিরল অতীন্দ্রিয়রাজ্যের রহস্যোদঘাটনের পরে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের দুঃখবাদ ও মোহিতলালের নির্ভয় দেহারতিতে তরুণ কবিরা যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, তেমনি অপরদিকে নজরুলের তীক্ষ্ণ বিদ্রোহবাদে তাঁদের মন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হল, বুর্জোয়া সমাজে যারা হরিজন, তাদের দুঃখ-বেদনার করুণ কাহিনী তাদের কর্ণগোচর হল—দেশের তরুণ-তরুণীদের মনে জেগে উঠল মুক্তির প্রাণকল্লোল। এতদিন ধারা বাংলা সাহিত্যের নির্জীব স্নায়ুশীলায় সৃষ্টির আনন্দময় আভিজাত্যে আবাল্য অভ্যন্তরীণ ছিলেন, এবার সেখানে দেখা দিল প্রেমের ললিতগীতির পরিবর্তে নিপীড়িতের আর্তনাদ, দুর্বলতার স্থানে বীরত্বপূর্ণ অভিযান—
: আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি আমি এমনি শক্তিমান। মম চরণের তলে মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান! (অভিশাপ)
কবি বলে প্রচারিত হয়েছেন, স্বয়ং কবিগুরুর সস্নেহ আশীর্বাদ পেয়েছেন। এর ফলে বাঙালী মুসলমান সমাজে মাতৃভাষায় সাহিত্য-রচনার উৎসাহ এবং তাতে গৌরব বোধ জেগেছে। পঞ্চম, বাংলা কবিতায় তাঁর আরবি-পারসী শব্দ-প্রয়োগ কবিতাকে শ্রুতি-মাধুর্য ও গতিমুখর করে তুলেছে। যদিও অকপটে স্বীকার করছি যে, তাঁর শব্দ-প্রয়োগ সব সময় সুপ্রয়োগ হয়নি। ভাবের অনুসরণে তাঁর শব্দচয়নের নিপুণতার উদাহরণ বিরল বলেই যেন আরও ভাল লাগে। যেমন—
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া।— “আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।” কাদে কোন ক্রন্দসী কারবালা কোরাতে, সে কাদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে। হুকুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে? আফতাব ছেযে নিল আঁধিযারা রাতিতে! আমান ভরে গেল গোধূলিতে দুপুরে, লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে! ফিরে এলো আজ সেই মোহরম মাহিনা, ত্যাগ চাই,—মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা। (মোহরম : অগ্নি-বীণা)
সত্যেন দত্ত মোহিতলাল ইতিপূর্বে আরবী-ফারসী শব্দের প্রচলন বাংলা কবিতায় করেছিলেন। কিন্তু সেটা নির্জলা কৃত্রিমতা বলেই মনে হয়েছে, কেননা মুসলমানদের ঐতিহ্য (tradition) তাঁদের কবিচিত্তকে গৌরবময়ী প্রেরণা ও উদ্দীপনা দান করেনি। তা করেছে নজরুল ইসলাম, যিনি ‘শাত-ইল আরব’, ‘খেয়াপারের তরী’, ‘কোরবাণী’, ‘মোহররম’, ‘কামাল-পাশা’, ‘জগলুল পাশা’, ‘মরু-ভাস্কর’ ও ইসলামী গান লিখেছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাসে মুসলিম সমাজজীবনের রীতিনীতি ও হালচাল আমরা প্রথম পেয়েছি। ‘প্রথম পেয়েছি’ কথাটা বলা হয়তো ভুল হলো ঐতিহাসিক দিক দিয়ে। কেননা ইতিপূর্বে কাজী ইমদাদুল হকের “আবদুল্লাহ” উপন্যাসে মুসলিম সমাজ-জীবনকে পাওয়া গিয়েছিল। বয়স্কতা ও ঐতিহাসিক ক্রোড়পত্রে হক সাহেব প্রথমজন হিসেবে অবৈধ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, কিন্তু তাঁর উপন্যাস বহুল পঠিত হয়নি কারণ তিনি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাংলা সাহিত্যকে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেননি। সমসাময়িক মুসলিমদের উপর তাঁর প্রভাব পড়েছিল, কিন্তু হিন্দু সমাজের উপর তাঁর প্রভাব একদমই পড়েনি। নজরুলই প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক যিনি তাঁর সমসাময়িক মুসলিম বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথের মত একটি যুগ সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথের পরও যে বাংলা কবিতা লেখা যায় তা দেখিয়ে দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম জন্মদাতা হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। কাজেই তিনি জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনোহরণ করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর গল্প-উপন্যাসে চরিত্র-চিত্রণে ও ঘটনা সংস্থাপনে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজের ক্রিয়া-কলাপের প্রতি আমাদের সকলের কৌতূহল সঞ্চার করেছে।
বাংলা ভাষায় নজরুলের দান। বাংলা ভাষার ছান্দসিকতা ও সূক্ষ্ম কারুকার্যতার কারণে করুণ পেলবতাকে তিনি শাণিত অস্ত্র করে তোলেন, প্রকাশ যেন দহন সূর্যরশ্মির মতো অনাবৃত। বাংলা ভাষার প্রেমে তিনি যেমন তার নরম সহচরী হয়েছিলেন, তেমনি তাকে হুকুম তামিল করাতে ভয় পাননি। “যুগবাণী”, “রুদ্রমঙ্গল”, “দুর্দিনের যাত্রী” বইয়ের বিষয়বস্তু অনেকাংশে আজকের দিনে বাতিল হয়ে গেলেও তার সংগ্রামিক ভাষা আজও আমাদের অনুকরণযোগ্য। কারণ স্বাধীনতার পরও যেখানে শাসকের নামে চলেছে অবাধ শোষণ, সেখানে বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করতে হলে ভদ্র বিনিময়ে নিবেদন পেশ করলে কেউ গ্রাহ্য করবে না, ভাষায় আনতে হবে তার মল রৌদ্রদীপ্ত পৌরুষের ঝলক। সবশেষে মূল্যবান কথা হলো, বাংলা কবিতার উপর নজরুলের প্রভাব পড়েছে রূপের দিক থেকে যতটা নয়, ভাবের দিক থেকে তার চেয়েও বেশি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, গোলাম কুদ্দুস, মহীউদ্দীন প্রভৃতি তার প্রমাণ।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর দানের ঝুলি এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। তাঁর প্রতিভা কাব্যলক্ষ্মীর দাক্ষিণ্য লাভ করেছে সেই গানের কথা বলা হয়নি এখনও। আবন্ত গানকে সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করতে কারুর প্রয়োজন আছে। নজরুলের ইসলামী সঙ্গীত শিক্ষিত মুসলমান সমাজের মধ্যে জাগরণ এনেছে। আধুনিক বাংলার ইসলামিক সমাজ কবির এই গানের নিকট বহুল পরিমাণে ঋণী। রামপ্রসাদের পর তামাসঙ্গীত রচনা করেন নজরুল। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি হৃদয়ের প্রবলতম ধারা হলো এই শাক্ত। শক্তিপূজা বাঙালি সমাজের একটি গৌরবজনক বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ বাংলার এই শাক্তরূপ গ্রহণ করেননি। ফলে শাক্ত বাংলার সঙ্গে তাঁর একটি ব্যবধান গড়ে উঠেছে। কাজেই তার দৃষ্টির মধ্যে যতটুকু বাঙালি ছিল ততটুকুতে সম্পূর্ণ বাঙালি চরিত্র ধরা পড়েনি। তিনি যেন একটি চলমান পৃথিবী—সমগ্র পৃথিবীর ভাবনাই তিনি ভেবেছেন। একটা ক্ষুদ্র দেশের জন্য সম্পূর্ণ মন-প্রাণ দিয়ে ভাবার অবসর তাঁর কোথায়! তিনি বাঙালি নন, বিশ্বনাগরিক। কিন্তু নজরুল বাংলাদেশের বাঙালি কবি, তাঁর মধ্যে শাক্ত বৈষ্ণব, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনাই তাঁকে সম্পূর্ণতা দান করেছে। তাঁর বীররসের কবিতা রচনায় কোন পরিণতি পাওয়া যায়নি; বন্ধনহীন জীবন-কল্লোলেই সেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে, কিন্তু তাঁর এই হামাসঙ্গীত ও ইসলামী গান রচনায় তাঁর মধ্যে একটি নিষ্ঠাবান সাধকের সুর আত্মনিবেদনাকারে আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি মুসলমান হয়েও শ্যামাসঙ্গীত রচনায় যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা অভূতপূর্ব, কেননা ইসলামে মূর্তিপূজা নিষেধের বাধাকে অপসারিত করে হামাসঙ্গীতের সাথে ইসলামী গান রচনা করে মুসলিম সমাজের হৃদয় জয় করা যে কত বড় প্রাণশক্তির পরিচয় প্রদান করে তা আজকের দিনে ভেবে অবাক হতে হয়। এক ধর্মে মূর্তিপূজা প্রধান, অন্য ধর্মে মূর্তিপূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ—এই দুই বিপরীতকে তিনি একটি বৃত্তে বেঁধে দিয়েছেন। হিন্দু সংস্কৃতি ও ইসলামিক ঐতিহ্য শুধু জ্ঞানের জন্য নয়—সম্ভব হয়েছে তাঁর সর্বসংস্কারমুক্ত প্রেমিক মনের জন্য। জ্ঞানী হওয়ার আগে কবিকে প্রেমিক হওয়া প্রয়োজন, কেননা প্রেমহীন জ্ঞানের কোন মূল্য নেই। বাংলা গানে নজরুল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলন ঘটিয়েছেন প্রেমের এই রাখীবন্ধন দিয়ে।
একটি গানের মধ্যে একাধিক রাগ-রাগিনীর সংযোগ ঘটিয়েছেন এবং একটি রাগকে ভেঙে বহু রাগিনীর সৃষ্টি করেছেন। তিনি যে রাগমিশ্রণের ধারা অবলম্বন করেছেন তা আমাদের ঐতিহ্যবিরুদ্ধ হয়নি। তাই তাঁর গান উচ্চাঙ্গ আসরে বসে গাইলেও একেবারে বেমানান হবে না। দ্বিজেন্দ্রলাল অতুলপ্রসাদের পর তিনিই আমাদের বাংলা গানের করুণ্যের একঘেঁয়েমি ঘুচিয়ে দিয়ে গায়ন-পদ্ধতিতে নমনীয়তার সঙ্গে দৃঢ়তার একটি সহজ ও সুন্দর সমন্বয় নিয়ে এলেন। শিল্পী ও সুরস্রষ্টা একত্র মিলিত হতে পেরেছেন তাঁর রচনায়, এইখানেই তার সার্থকতা। মার্গসঙ্গীতের ভূয়ো আভিজাত্যকে তিনি দূরে সরিয়ে দিয়ে বাংলার লোকসঙ্গীত—যার মধ্যে বাংলার প্রাণধারা প্রবহমান—তাকে তিনি স্থান দিয়েছেন আমাদের অভিজাত গানের মহলে। এখানেও তাঁর নিজস্ব রীতি অনেকখানি রয়েছে এবং মাঝে মাঝে রাগসঙ্গীতের স্পর্শও তিনি এনেছেন নিপুণভাবে। সুরবৈচিত্র্য ছাড়াও তিনি নিজস্ব কতগুলো সুর সৃষ্টি করেছেন, যেমন ‘বনকুন্তলা’, ‘সন্ধ্যামালতী’, ‘দোলন-চম্পা’ প্রভৃতি। আরব-মিশর পারান্ত-তুরস্ক দেশের গানের সুর বাংলা গানে ফুটিয়েছেন। আমাদের সঙ্গীতিক রুচির যথেষ্ট উন্নয়ন করেছিলেন প্রাচীন-রীতিকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ না করেও সঙ্গীতের একটি বিরাট সংস্কার সাধন করেছিলেন—এটাই হলো বাংলা গানে তাঁর দান সম্পর্কে শেষ কথা এবং সারকথা।
কথার শেষে মনে করিয়ে দিই যে সংস্কৃতিপরায়ণ মনের সুক্ষ্ম উপলব্ধি দিয়ে তাঁর কবিতা বা গানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য উপভোগ করার দরকার হয় না, যাতে সকলের ভালো লাগে, বক্তব্য বিষয়কে অস্পষ্ট না করে সোজাহুজি মানুষের মন ছুঁতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই তিনি তাঁর সাহিত্যকে নিতান্ত সহজবোধ্য করেই রচনা করেছেন। সেইজন্য সকল শ্রেণীর সকল স্তরের মানুষের মধ্যে নজরুল এত জনপ্রিয়। এজন্য স্বাভাবিক কারণে ২৫শে বৈশাখের মত ১১ই জ্যৈষ্ঠও জাতীয় উৎসবের দিন হিসেবে পরিণত হতে চলেছে।
আলোচনাটা এখানেই শেষ করতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু নজরুল সাহিত্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করা জরুরি মনে হয়। গত শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলা কবিতার নতুন জীবন ও বৈপ্লবিক অর্থের জন্ম দেওয়ার জন্য নজরুল শুদ্ধতার নীতি থেকে সাময়িক দূরে সরে এসেছেন, যার ফলে তাঁকে বহুবিধ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে নজরুলের বাস্তব জীবন থেকে এটি জানা যায় যে, স্বীকার করেই তিনি সমস্ত সাহিত্যকর্মে ‘মিনার’ এর মত এক নির্যাতিত জাতির দুঃখভোগ করে গেছেন, কারণ সেই মতের সুর কখনোই তাঁর সৃষ্টিতে প্রবাহিত হয়নি। যুগ-সমাজ-মানুষের মেলবন্ধন একমাত্র নজরুলের সাহিত্য-নেশার মধ্যে গিয়েও পাওয়া গেছে। যে বাঙালি সমন্বয়-পরিচয়ে, আত্মমর্যাদা, মানবিক মূল্যবোধে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল নজরুলের কাছে দাঁড়িয়ে সুরেলা ও বলিষ্ঠ শব্দের মাধ্যমে এক বিরাট চিত্রপট সৃষ্টির মাধ্যমে। সেই চিত্রপটে কাজী নজরুল ইসলাম ‘জাতির কবি’ বলে একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছেন, যেখানে অপরাধের বাণী নয়, প্রীতির বাণী গাওয়ার জন্য তিনি অদ্বিতীয়।
এবার নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, সাহিত্য-অঙ্গনে নজরুল সর্বাপেক্ষা প্রভাবী, বিপ্লবী ও মনোমুগ্ধকর এক কবি হিসেবে স্বীকৃত।