বাঙালীর জীবনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মিলনভূমিতে স্থাপন করে মননশীল সাহিত্য, কথাসাহিত্য, দেশ ও দশের কথা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালীকে যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনরস ও প্রাণবানীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। বাঙালীর মনকে মননের দ্বারা সুদৃঢ় করে, সংস্কারকে যুক্তি দিয়ে, প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে স্বাদেশিক মন্ত্রদীক্ষায় নতুন মানববোধের পন্থা নির্দেশ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭১) বাঙালী সমাজ আত্মদর্শনের বীজমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। পাশ্চাত্য উপন্যাস ও রোমান্সের প্রভাবে সর্বপ্রথম বাংলা উপন্যাসের কাঠামো সার্থকভাবে নির্মাণ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। Indian Field পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস Rajmohan’s Wife প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে লেখা এই জড়তাপূর্ণ কাহিনী বাঙালীর পারিবারিক জীবনের কথা। এরপর পরপর রচনা করেছেন তাঁর সার্থক বাংলা উপন্যাসগুলি:
১) দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)
২) কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬)
৩) মৃণালিনী (১৮৬৯)
৪) বিষবৃক্ষ (১৮৭৩)
৫) ইন্দিরা (১৮৭৩)
৬) যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪)
৭) চন্দ্রশেখর (১৮৭৫)
৮) রজনী (১৮৭৭)
৯) কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)
১০) রাজসিংহ (১৮৮২)
১১) আনন্দমঠ (১৮৮৪)
১২) দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪)
১৩) রাধারানী (১৮৮৬)
১৪) সীতারাম (১৮৮৭)
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য ধরে উপন্যাসগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। তাঁর ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী উপন্যাসগুলি হল: দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, রাজসিংহ, এবং সীতারাম। অবশ্য অনেক উপন্যাসেই ইতিহাসের পটে অনৈতিহাসিক মানুষের কথা অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে বিমলা-আয়েষা-তিলোত্তমা, ‘কপালকুণ্ডলা’য় কপালকুণ্ডলা-স্মৃতিবিধি-নরকুমার, ‘মৃণালিনী’তে হেমচন্দ্র-পশুপতি-মৃণালিনী-মনোরমা, ‘চন্দ্রশেখর’এ চন্দ্রশেখর-প্রতাপ-শৈবালিনী প্রভৃতি চরিত্র ও তাদের ঘটনা অনেকাংশেই কাল্পনিক। অসাধারণকে অবলম্বন করে, বিস্ময়ভাব আশ্রয়ী, বাস্তব কথার জীবনসত্য ও মানব সত্যের স্বীকৃতিতে প্রত্যক্ষতার আনন্দ নিয়ে তাঁর অদ্ভূতরস রোমান্সধর্মী উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচিত। ‘কপালকুণ্ডলা’য় রয়েছে নদী ও অরণ্যের সৌন্দর্য, কপালকুণ্ডলার বিবাহিত সামাজিক জীবনের নানা দুঃখ ও নিয়তি। তাঁর ‘মৃণালিনী’ অপূর্ব কাহিনী গ্রন্থনা ও চরিত্রবিন্যাসে রচিত, যদিও যুগের ঐতিহাসিক উপাদানের অভাবে এটি অনুমাননির্ভর ইতিহাসরসাশ্রিত কাহিনী। ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ কাহিনী এবং চরিত্রগত দিক থেকে দুর্বল উপন্যাসটিতে হিন্দু আমলের একটি রোমান্টিক প্রেমের গল্প। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ মীরকাশিমের সময়ের পটভূমিকায় রচিত উপন্যাস, যেখানে নীতির মাপকাঠিতে প্রতাপ-শৈবালিনীর সম্পর্ক বিচার করে চিত্তসংযমে অসমর্থা শৈবালিনীর নরকযন্ত্রণা ভোগের প্রায়শ্চিত্তের কথা বর্ণিত। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসটি বঙ্কিমের বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস। তবে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কাল্পনিক প্রণয়ের নানা উপকাহিনী ইতিহাসরসকে অক্ষুণ্ণ রেখে সংযোজিত। তাঁর ‘সীতারাম’ ক্ষীণতম ইতিহাসের আভাসে, কল্পনার আতিশয্যে চরিত্রবান পুরুষের রূপের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার অধঃপতনের চিত্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস হল ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪) এবং ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৮৮৫)। আনন্দমঠে উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে রচিত। এখানে অন্তর্ভুক্ত ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত পরাধীন জাতির বীজমন্ত্র। বাংলাদেশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটি। মহেন্দ্র-কল্যাণী-ভবানন্দ, সত্যানন্দ, জীবনন্দ, নিমাই প্রভৃতি চরিত্রের উপস্থাপনায় দেশাত্মবোধক এই উপন্যাসে বঙ্কিম দেশ, সমাজ, ধর্ম ও জাতীয়তা সম্পর্কে নতুন ভাবনা ও তত্ত্বদর্শন প্রকাশ করেছেন। তাঁর ‘দেবী চৌধুরানী’ সুমধর্মীয় অনুভূতি ও হিন্দুর সামাজিক আচার-আচরণের নানা তত্ত্ব নিয়ে রচিত। সেই সঙ্গে গীতা-তত্ত্ব ও হিন্দু নারীর অবস্থান সম্পর্কিত নানা উপদেশ এখানে প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাসগুলি হল বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, এবং রাধারানী। ইতিহাস বা তত্ত্বকথা নয়, নরনারীর মনের বিচিত্র ভাব এবং সামাজিক নানা সমস্যাকে নিয়ে তাঁর এই শ্রেণীর উপন্যাসগুলি রচিত। বিষবৃক্ষ উপন্যাসটি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহ, ব্রাহ্ম আন্দোলনের মতো সমকালীন নানা সামাজিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপনের পাশাপাশি বৈধব্য সাপেক্ষ মনস্তাত্ত্বিক জটিল ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্ব ও ঘাত-প্রতিঘাত (নগেন্দ্র-কুন্দনন্দিনী-সূর্যমুখী) এখানে বর্ণিত হয়েছে। ইন্দিরা বুদ্ধিদীপ্ত উচ্ছ্বল প্রতিভার স্বাক্ষরে কাহিনীর ক্ষুদ্র আয়তনে দাম্পত্য জীবনের রসসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্কিমের রজনী উপন্যাসটি লিটনের The Last Days of Pompeii-এর প্রভাবে রচিত। অর্থাৎ নিদিয়ার প্রভাব পড়েছে জন্মান্ধ রজনী চরিত্রে। যেখানে নীতি, সমাজ, সংস্কার প্রবল হৃদয়বৃত্তির স্রোতে ভেসে যায়, সেখানে নীতির প্রশ্নে নারী হৃদয়ের দুর্বলতম ব্যথার অমর্যাদা করেননি বঙ্কিম। কৃষ্ণকান্তের উইল বঙ্কিমচন্দ্রের একটি কালজয়ী গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস। এখানেও তিনি অঙ্কন করেছেন ত্রিকোণ প্রেমের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। কাহিনীগ্রন্থনা ও বিস্ময়কর চরিত্র সন্নিবেশে নারীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংস্কারের দ্বন্দ্ব পেয়েছে ভ্রমর-রোহিনী-গোবিন্দলালের বৈধব্য সাপেক্ষ ত্রিকোণ চিত্রে। বঙ্কিমের রাধারানী উপন্যাসে পুরুষের নৈতিক অধঃপতনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা প্রকাশিত হয়েছে। এখানে দেবেন্দ্রনারায়ন-রুক্মিণীকুমারের গল্প বর্ণিত হয়েছে। বলা যায়, ইহা জীবনসমস্যার চিত্র নয়, বরং সাধারণ প্রেমকথা।
বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসে দেশ, সমাজ, জাতি, ধর্ম, সামাজিক আন্দোলন, যা-ই হোক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভাবধারার সাঙ্গীকরণে নারী চরিত্রের দৈহিক, মানসিক সৌন্দর্য রূপায়ণে, ত্রিকোণ প্রেমের দ্বন্দ্বে গভীর মনস্তাত্ত্বিক আলোড়নের সৃষ্টি করে উপন্যাসের আলোচ্য চরিত্রদের সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্রগুলিতে রক্তমাংসের স্পর্শ আছে। সেই চরিত্রগুলিকে তিনি বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তঃস্থ সত্তাকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে নানা রূপে প্রকাশ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর উপন্যাসের কাহিনীগুলিতে আত্মা হিসেবে বাঙালী সমাজের পরিচয়কে তুলে ধরেছেন, যা বাংলা কথাসাহিত্যের আদি নিদর্শন। তাই বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের জনক বলা হয়।