বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: বাংলা সাহিত্যে বিশ্ব বন্দনীয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান কতটুকু সে বিষয়ে চর্চা বা মূল্যায়ন করা সমুদ্র থেকে এক বালতি জল তোলার তুল্য। কারণ তাঁর সাহিত্য সম্ভার এতবহুল ও বৈচিত্র্যময় যে একজন সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁর মূল্যায়ন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সাহিত্যের এমন কোন ধারা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া লাগেনি। তাঁর সহজাত প্রতিভা বলে তিনি একের পর এক কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। যা কালের নিয়মে এখনো প্রাসঙ্গিক। তাঁর সৃষ্টিকর্ম যদি আমরা সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করি তাহলে বলা যায় তিনি প্রায় দুই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন, ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প ৩৬টি, প্রবন্ধগ্রন্থ, ৫০টি নাটক রচনা করেছেন। এছাড়াও কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫৩টি। এছাড়াও লিখেছেন শিশুদের উপযোগী বহু ছড়া ও কবিতা। সম্পাদনা করেছেন বহু পত্রপত্রিকা। বহু লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। লোক সাহিত্য, সংস্কৃতির, প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ যা তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির বিষয় হয়ে উঠেছ।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। যার অবদানে বাংলা সাহিত্য তথা ভারতীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সচ্ছন্দে বিচরণ করেননি। তিনি শুধু বাঙালির নন, সমস্ত ভারতীয়দের কাছে গর্বের। তাঁর অবদান যে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ তা নয়, তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সাহিত্য ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষা দর্শনে, সমাজ সংস্কার আন্দোলনে, স্বাধীনতা সংগ্রামের, মানবতাবাদ প্রকাশে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে, সঙ্গীত জগতে, শিল্পকলা প্রদর্শনে, প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বাংলা সাহিত্যে তিনি সূর্য। সূর্যের আকর্ষণে যেমন গ্রহ উপগ্রহ আবর্তিত এবং আলোকিত হয় ঠিক তেমনি বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি সূর্য। তাঁর আলোয় আলোকিত বাংলা সাহিত্য সম্ভার। এবং তাঁর আকর্ষণে গ্রহের ন্যায় ঘোরে বাংলার সমসাময়িক এবং পরবর্তী কবিগন। তাঁর অসাধারন পাণ্ডিত্য, বিশ্বজোড়া খ্যাতি, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে কবিদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে সমসাময়িক সময়ে কেউ কেউ কবিকে কবিগুরু পদে বরণ করে নিয়েছিলেন। আবার অনেকেই তাঁর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রবি ঠাকুরের কাব্য প্রতিভার মহিনীমায়াকে অস্বীকার করতে পারেননি। ঠাকুরের কাব্য প্রতিভার মায়াজালের এমনই শক্তি ছিল যে একবার তাঁর কাব্য মোহিনী মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন সে চোরাবালির অতলতলে তলিয়ে গেছেন। আবার এটাও সত্য সমসাময়িক সময়ে অনেক কবিই রবীন্দ্রকাব্য ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র সাহিত্য ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। যাদের আমরা রবীন্দ্রবিরোধী কবি গোষ্ঠী বলে থাকি। তাদের মধ্যে রয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আরো অনেকে। কিন্তু গুরুদেবকে ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপায় ছিলনা। তারা প্রত্যেকেই আপন আপন ক্ষেত্রে যেমন কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহীসুর, যতীন্দ্ৰ নাথ সেনগুপ্ত বাস্তবতাঁর কথা, মহিতলালের দুঃখবাদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য- কবিতা ছন্দু সুরের মাধুর্য প্রমুখ কবিগণ তারা এক একটি দিক নিয়ে বলেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তিনি মহাসাগর। নদী যেমন সমুদ্রে মেশে ঠিক তেমনি সেই সময়ে কবিগণ তাদের একমুখী প্রতিভা নিয়ে বহুমুখী প্রতিভাধারী মহাসাগরের তুল্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে প্রকৃতিপ্রেমিক, রোমান্টিক, আধ্যাত্মিক চেতনাবাদী, স্বদেশী চিন্তনে বিশ্বাসী, বহির্বিশ্বের শিক্ষা – সংস্কৃতির মেলবন্ধনকারী। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় ধারাকে করেছে সমৃদ্ধশালী।
সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁর স্বদেশ চেতনার জাগরন ঘটিয়েছিল। এ বিষয়টিকেও তিনি সাহিত্যের অঙ্গ করেছিলেন। বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবনা, তত্ত্ব ও দার্শনিকতা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর প্রভাবও আমরা তাঁর রচনায় লক্ষ্য করেছি। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ই প্রভাব আমরা দেখতে পেলাম বিভিন্ন কাব্য এবং নাটকে। বিভিন্ন পুরানের প্রভাবও তাঁর সাহিত্যে লক্ষ্য করা গেছে, আবার দীন-দরিদ্র নির্যাতিত মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, তাদের আশা আকাঙ্খার কথা, দাম্পত্য জীবনের জটিল টানাপোড়নের কাহিনী তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকে করে তুলেছে সমৃদ্ধশালী। বাংলা সাহিত্য রচনার জন্য তাঁর উপাদানের অভাব ছিল না কারণ তিনি দুচোখ ভরে যা দেখেছেন তাই সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন এবং তা কালজয়ী সৃষ্টি হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা গুলো আলোচনা করা প্রয়োজন। ১২ বছর বয়সেই তাঁর বাংলা সাহিত্যের জগতে পদার্পণ। ১৮৭৩ সালে রচনা করেছিলেন “ দ্বাদশ বর্ষীয় বালক রচিত অভিলাষ”, তাঁর পর “পৃথ্বীরাজ পরাজয়” “হিন্দুমেলার উপহার”। গতানুগতিক বাংলা কাব্যজগতে তিনি নবরূপ দান করলেন। ছন্দ ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটালেন। কবিতায় ব্যাবহার করলেন গদ্য ছন্দ। ভাবের বৈচিত্রে, রসের মাধুর্যে বাংলা কাব্য সাহিত্যে নতুন রূপে সেজে উঠল। তিনি বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিশুদ্ধ রোমান্টিকতা, গীতিধর্মীতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা, অধ্যত্মচিন্তন ও চেতনা ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তিনি ছিলেন ভাববাদী – প্রকৃতিবাদী – অধ্যাত্মবাদী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন একটি সীমায় সীমাবদ্ধ করা যায় না। তিনি সর্বত্রই সীমার মধ্যে অসীমকে খুঁজেছেন এবং সুন্দরের আরাধনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর কাব্য জগতকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজন করা যেতে পারে। যেমন সূচনাপর্ব, উন্মেষ পর্ব, অন্তর্বর্তীপর্ব, গীতাঞ্জলিপর্ব, বলাকাপর্ব, গোধূলিপর্ব। “প্রভাত সঙ্গীত” কাব্যে তিনি হৃদয় অরণ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হতে চাইছিলেন। তিনি বললেন “ হৃদয় আজি মর কেমনে গেল খুলি / জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি”। “সোনার তরী” কাব্যের প্রকৃতি চেতনা বা নিসর্গের অপূর্ব মাধুর্য ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেল। অন্তর্বর্তী পর্যায় রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনা ও প্রকৃতি চেতনা অপূর্ব মাধুরী ধরা পড়েছে এই পর্যায়ের কাব্য কবিতার মধ্যে। নৈবেদ্য” কাব্যে গীতিধর্মীতা লক্ষণীয়। কবি এখানে মানুষের লোভ লালসা, কামনা বাসনাকে বিদ্রুপ করেছেন। “গীতাঞ্জলি” কাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ। এই পর্যায়ে রয়েছে কবির অধ্যাত্ম চেতনার বৈচিত্র্যময় রুপ। অন্ত্যপর্ব বা গোধূলি পর্বে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু চেতনা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাংলা কাব্য সাহিত্য জগতে তিনি মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিত্রণে রূপকার রবীন্দ্রনাথ। তাঁর দৃষ্টিতে প্রকৃতি এক অপরূপ মাধুর্য নিয়ে পাঠকের কাছে হাজির হয়েছে। প্রকৃতিকে এত গভীরভাবে উপলব্ধি করা, প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করা বোধহয় বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে ঘটেনি। তাই বলা যায় বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির চিত্র চিত্রনে সার্থক চিত্র যোজনার রূপকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্যে কল্পনাময়তা, ভাব তন্ময়তাঅতি প্রাকৃত বিষয় তথা রোম্যান্টিকতার সার্থক রূপকার হলেন কবিগুরু। ভোগবাসনা ক্ষণস্থায়ী রূপ, অন্তরের চিরন্তন সৌন্দর্যই সার্বজনীন রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্য তার সার্থক পরিচয়বাহী। গীতিকবিতার শিল্পসম্মত রূপকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারার পর্বগুলিকে বিভিন্ন সাহিত্যিকগণ বিভিন্নভাবে বিভাজন করেছেন। তার কাব্যের পর্বকে মোটামুটি ভাবে সূচেনা পর্ব, উন্মেষ পর্ব, ঐশ্বর্য পর্ব,অন্তর্বর্তী পর্ব,গীতাঞ্জলিপর্ব, বলাকা পর্ব, পুনশ্চ বা গদ্য কবিতার পর্ব এবং শেষ পর্ব এভাবে বিভাজন করা যেতে পারে। এই বিভিন্ন পর্যায়গুলি বিভিন্ন কাব্যিক বৈশিষ্ট্য ও কবি প্রতিভার গুনে গুণান্বিত। কাব্য কবিতার রচনার প্রথম দিকে তিনি গাথা কাব্য হিন্দু মেলার উপহার, অভিলাষ, বনফুল, কবি কাহিনীর মত গাথা কাব্য রচনা করেছেন। প্রথম পর্বের রচনাগুলিতে ব্যর্থ প্রেমের আখ্যানচিত্র চিত্রিত হয়েছে। সেখানে গীতিকবিতা, রোমান্টিকতা, আবেগ উচ্ছ্বাসপূর্ণ কাব্যিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। উন্মেষ পর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৌলিকতার পরিচয় লক্ষ্য করা গেছে। কবি নিজেই — সন্ধাসংগীত’ কাব্যেই তাঁর প্রথম পরিচয় বলে উল্লেখ করেছেন। এই পর্বেই রবীন্দ্রনাথের নিবিড় ইন্দ্রিয় চেতনা, , জীবনের প্রতি গভীর আসক্তি এবং বিষয়ের প্রতি বৈচিত্র্যতা এই পর্বের বিভিন্ন কাব্য – কবিতাগুলির
মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ঐশ্বর্য পর্বের কাব্যগুলিতে কবির জীবন দর্শনের সঙ্গে মর্ত্য প্রেমের এক মেলবন্ধন লক্ষ্য করা গেছে। কবি রোমান্টিক কল্পনা, জীবন দর্শন, কাব্য সৃষ্টির সৃজনশীল মৌলিকতা এই পর্বের কাব্যগুলিকে একটি ভিন্নমাত্রা দান করেছে। গীতাঞ্জলি পর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্বের কবি সাহিত্যিকগণের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিল। এই পর্বে তার আধ্যাত্মিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আধ্যাতিক চেতনার সঙ্গে মর্ত পৃথিবীর আসক্তির উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিল এই পর্বের কাব্য- কবিতাগুলির মধ্যে। বলাকা পর্বের বিভিন্ন কাব্য কবিতার মধ্যে সেখানে গতিতত্ত্ব ও যৌবন তত্ত্বের অপরূপ মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কবি সেখানে। আবার কবিতা শুধুমাত্র যে বিভিন্ন ছন্দের বন্ধনের আবদ্ধ নয়, গদ্য কবিতার মধ্য দিয়ে তার যে মুক্তির স্বাদ কবিতার প্রাণ, তা তিনি পুনশ্চ পর্বের বিভিন্ন কাব্য কবিতার মধ্যে দেখিয়েছেন।নারীর অন্তরের কথা, বিধবা নারীর অন্তরের দ্বন্দ্ব মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে তুলে ধরেছিলেন চোখের বালি উপন্যাসে যা বাংলা সাহিত্য যথার্থই অভিনব। আবার ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস নারী জীবনের সার্থকতা কোথায় এ ধরনের জটিল জিজ্ঞাসা উপন্যাসের স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপন্যাসগুলিতেও লক্ষ্য করা গেছে। ‘গোরা’ ‘ঘরে বাইরে’ ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসগুলোতে। উপন্যাসগুলোতে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধিতা, ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ লক্ষ করা হয়েছে। রোমান্স, কাব্যধর্মী, রোমান্টিক উপন্যাস তিনি লিখেছেন শেষের কবিতা’ চতুরঙ্গ’ দুই বোন’ মালঞ্চ’ তার নিদর্শন।
Peculiar product of nineteenth century হলো ছোট গল্প। বাংলা সাহিত্যে যার স্বার্থক শ্রোষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম রবীন্দ্রনাথেরই ছোট গল্পের মধ্যে দিয়ে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করল বাঙালী পাঠক। ছোটগল্পে মধ্যে থাকে এক নিবিড় ভাবৈক্য, কাহিনী হয় গতিময়, রচনাশৈলী হয় ঘনপিনদ্ধ, ব্যাঞ্জনাধর্মীতা ছোট গল্পের প্রাণ যা রবীন্দ্র সৃষ্ট ছোটগল্পে লক্ষণীয়। ভাবে ও বিষয় বৈচিত্র বাংলা ছোটগল্প যে বৈচিত্র্যময়তা তা কবি গুরুর দান। তাঁর ছোটগল্পগুলোকে মোটামুটি কয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন পারিবারিক, সামাজিক, প্রকৃতি বিষয়ক, অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক প্রভৃতি।
“রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ মহাকবি হাতের প্রবন্ধ” – অতুলচন্দ্র গুপ্তের এই মতটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করি। তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে রাজাধিরাজ। তিনি মূলত কবি। তাঁর প্রতিভা মূলত গীতি কবির প্রতিভা তা সত্ত্বেও তিনি কথাসাহিত্যে ও প্রবন্ধের অনায়াসে তাঁর প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমপূর্ব, বঙ্কিমচন্দ্র এবং বঙ্কিমগোষ্ঠীর প্রবন্ধ সাহিত্য বিকাশের যে পথ তৈরি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই দুর্গম পথকেই করে তুলেছেন মসৃণ। বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর গোষ্ঠী ইষ্টখন্ড জোগার করে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা দিয়ে ইমারত গড়লেন। যুক্তির পারম্পর্যে চিন্তা নির্ভর বক্তব্য প্রধান বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের ধারার পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ সেখানে আত্মভাবাশ্রয়ী ব্যাক্তি চৈতন্যলোকে উত্তীর্ণ করলেন বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে। বাংলা সাহিত্যে বিশ্লেষানাত্মক পদ্ধতির পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ সংশ্লেষাত্মক পদ্ধতি রচনায় মনোনিবেশ করলেন। যেটা বাংলা সাহিত্যে অভিনব। যা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেল। রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি তাই তাঁর স্পর্শে বহু জটিল, জ্ঞানগর্ভ, দার্শনিক তত্ত্বসমূহ সহজ সরল হৃদয়গ্রাহী শিল্প রসে অভিসিক্ত হয়ে উঠল বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য। সাহিত্য সমালোচনা, রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনা, বাংলা ব্যাকরণ ধ্বনিতত্ত্ব ও রুপড়ের স্বরুপ আলোচনা, ছন্দ বিচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি সহজ-সরল ভাষায় আলোচনা করে প্রবন্ধ সাহিত্যে নব দিগন্তের দ্বার খুলে দিলেন। তাঁর সমগ্র প্রবন্ধ সাহিত্যকে মূলত – সমালোচনা মূলক, রাজনৈতিক, শিক্ষামূলক, ধর্ম – দার্শনিক, ব্যক্তিগত এবং ভ্রমনমূলক প্রভৃতি বিভাগের বিভাজন করা যেতে পার।
সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি বৈচিত্র এনেছিলেন। নাটকের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম হয়নি। নাটকে গানের প্রাধান্য দিয়ে গীতিনাট্য, কাব্য গুণের প্রাধান্য দিয়ে কাব্যনাট্য, নাট্যগুনকে প্রাধান্য দিয়ে নাট্যকাব্য রচনা করে তিনি নাটকের ক্ষেত্রেই বৈচিত্র্যতা আনলেন। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ ‘মায়ার খেলা’ কর্ণ কুন্তী সংবাদ — গান্ধারী আবেদন’ এরকম বহু নাটক তিনি লিখলেন। এক একটি নাটকে তিনি এক একটি দিককে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন ‘ রাজা ও রানী’ নাটকে কর্তব্যের সঙ্গে প্রেম। ‘বিসর্জন’ নাটকে আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে প্রথার দ্বন্দ্ব। কৌতুক নাটকের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, অন্যায় – সমাজের ব্যভিচার,
বাংলা কথা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। কথাসাহিত্যের দুটি ধারা উপন্যাস ও ছোটগল্প। এই দুটি ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা সাহিত্যের অভিনবত্ব দান করেছেন। উপন্যাসের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক প্রকরণ, , শৈল্পিক কর্মকুশলতা, চরিত্র-চিত্রন, কাহিনীর বিচিত্রতা সর্বক্ষেত্রে তিনি নতুনত্ব এনেছেন। সর্বোপরি বাংলা উপন্যাসের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, নর- নারীর আন্তরের কথা টেনে বের করেছিলেন যা বাংলা উপন্যাসে যথার্থই অভিনব। তাঁর উপন্যসগুলিতে সমাজের নিষ্ঠুর আবর্তের মাঝে একটি মধুর, নমনীয় ও সরল প্রাণে যন্ত্রনা প্রস্ফুটিত। ঐতিহাসিক ঘটনা অবিকৃত রেখে শৃঙ্খলাপূর্ণ কল্পনার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বউ ঠাকুরাণীর হাট” “রাজর্ষি” উপন্যাস দুটি রচনা করেন। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে দোলায়িত ও নারীদের অন্তরের কথা টেনে বের করেছেন “চোখের বালি” উপন্যাসে। বালবিধবা বিনোদিনীর চিত্তে পুরুষের প্রতি দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা এবং মহেন্দ্র – বিনোদিনী বিহারীলাল ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী অবলম্বনে রচিত “চোখের বালি” উপন্যাসটি। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই নারীর অধিকার, তাদের বঞ্চনার কথা, অবজ্ঞা অবহেলিত হওয়ার কথা. তুলে ধরেছেন। “নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দেবে অধিকার”। বাল্য বিধবাদের দুঃখের কথা, তাদের অন্তরের কথা তিনি প্রথম সাহিত্যের আঙ্গনে তুলে ধরলেন। কমলার তরল রোমান্সের কাহিনী অবলম্বনে রচিত “নৌকাডুবি” উপন্যাসটি। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, জীবনের বৃহত্তর সমস্যা, স্বদেশীকতা ও সমাজ সমস্যা বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা তৎকালীন নরনারীর জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তার কথা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন উপন্যাসে। যেমন “ঘরে বাইরে” “গোরা” “চার অধ্যায়” উপন্যাসে। “গোরা” উপন্যাসটি একটা সমগ্র জাতির মানুসিক সঙ্কটের কাহিনীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি জাতির মনে প্রকৃত স্বদেশচেতনা, স্বদেশী ভাবনা, প্রকৃত দেশাত্মবোধ জাগরণের জন্য তিনি বিভিন্ন উপন্যাসে তা তুলে ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মিস্ট্রিক ও রোমান্টিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ছিলেন তিনি সিদ্ধহস্ত “চতুরঙ্গ” “শেষের কবিতা” উপন্যাস দুটি তাঁর নিদর্শন। তিনি একটি যুগের সৃষ্টি করেছেন। সমসাময়িক সময়ে তিনি এতটাই প্রাসঙ্গিক ছিলেন যে তাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্র যুগ সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্র পরবর্তী, রবীন্দ্র সমসাময়িক এবং রবীন্দ্র পরবর্তী। এ প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় “বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত “গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন – “ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকে যেমন বঙ্কিমযুগ নাম দেওয়া হয়, তেমনি বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে রবীন্দ্রযুগ নাম দেওয়া যেতে পারে”।
তিনি একজন শ্রেষ্ঠ কবি হয়েও কথাসাহিত্যের জগতেও তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তার ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে ইতিহাসের তথ্য, সত্যকে অবিকৃত রেখে নিজের সৃজনশীল প্রতিভারগুনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ নামক উপন্যাস দুটি। ত্রিপুরার রাজবংশের এক বিশেষ সমস্যা নিয়ে রচিত ‘রাজর্ষি আর প্রতাপাদিত্যের কাহিনী রচিত হয়েছিল ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাস।
ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তীব্র কষাঘাতে মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন। যেমন চিরকুমার সভা’ গোড়ায় গরল’ — হাস্যকৌতুক— — ব্যঙ্গ কৌতুক’ নাটকের মধ্য দিয়ে। রূপক সাংকেতিক নাটক রবীন্দ্রনাথের অভিনব সৃষ্টি। এর মধ্য দিয়ে তিনি জীবন ও জগতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘মুক্তধারা’ নাটকে যন্ত্রের সঙ্গে জীবনের লড়াই এবং জীবনের সেখানে জয়। ‘রাজা’ নাটকে অরূপের সন্ধান, অচল আয়তন নাটকে প্রথা ও সংস্কারের দ্বন্দ্ব, ‘ রক্তকরবী’ নাটকের সৌন্দর্য ও প্রাণের আহ্বান ঘোষণা মধ্য দিয়ে বাংলা নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনবত্ব নিয়ে আসেন।
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নাট্য- অভিনয়, দর্শকের মনোরঞ্জন থেকে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করলেন। নাটককে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত করলেন। নাটক শুধুমাত্র দৃশ্য ও অভিনয়যোগ্য স্তরে আর সীমাবদ্ধ থাকলো না তা হয়ে উঠল সাধারণ পাঠনীয়। নাটকে তিনি বিচিত্র ধারার আমন্ত্রণ জানালেন এবং রূপক সাংকেতিক নাটকের উদ্ভাবন করলেন যা বাংলা সাহিত্যকে অভিনব রূপ দান করল। তিনি নবীন ইউরোপীয় প্রচেষ্টার সঙ্গে বাংলা নাটকের সামঞ্জস্যবিধান করলেন। রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা নাটককে এক অভিনব ধারার প্রবর্তন করলেন যা রূপক সাংকেতিক নাটক নামে অভিহিত। “রাজা”, “ডাকঘর” “মুক্তধারা” “রক্ত করবী” আরো অনেক। গানের মধ্য দিয়ে নাটককে তিনি ধরার চেষ্টা করেছেন এবং নৃত্যের মধ্য দিয়ে তিনি তাকে দৃশ্যরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, চণ্ডালিকা প্রভৃতি নাটকে মধ্য দিয়ে নাটকের এই Form বাংলা সাহিত্যের যথার্থ অভিনব।
পরিশেষে বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ বাঙালি তথা জাতির জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্যকে কল্পনা করা যায় না। রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা, রবীন্দ্রসাহিত্য গবেষণা, তাকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সভার আয়োজন বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে। বাঙালির গৌরব যে রবীন্দ্রনাথের ন্যায় প্রতিভাবান এবং মহা মনীষীর আবির্ভাব বাংলার মাটিতেই হয়েছিল। ধন্য বাংলা, ধন্য বাঙ্গালী, ধন্য ভারতবাসী। তাঁর মৃত্যুর ৮২ বছর পরেও তিনি এখনও প্রাসঙ্গিক, তাই তাকে নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন আলোচনা চক্র। তাঁর বাণী, তাঁর কাব্য কবিতা মানবজাতির অন্ধকার থেকে আলোর দিশা দেখাবে। যতদিন বাঙালীর অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তিনি বাঙালি হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করবেন। শরৎচন্দ্র সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায় “কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই”। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে একথাই সর্বশেষ কথা ।
সহায়ক গ্ৰন্থপুঞ্জি
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদানঃ একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
সংকল্প কুমার মণ্ডল
সহকারী শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১। বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রী অসিত কুমার (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬, পুনর্মুদ্রন, ২০০৩-৪) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, প্রকাশক মডার্ন বুক এজেন্সি পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৬৬।
২। আচার্য্য ড.দেবেশকুমার ( প্রথম প্রকাশ আগষ্ট, ২০০৪, ৪র্থ পুনর্মুদ্রন, ২০১৪) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ইউনাইটেট বুক এজেন্সি)
৩। চট্টোপাধ্যয় ড.তপনকুমার প্রথম প্রকাশ ২০০৪, পুনর্মুদ্রন, ২০১৯) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রজ্ঞা বিকাশ।