ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদবধ। দৈবাস্ত্র লাভ করবার পর লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের কাছে সেটি কীভাবে পেলেন তা বর্ণনা করে। তিনি জানান লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী চণ্ডী বলেছেন দেবতারা সকলে তাঁর প্রতি প্রসন্ন। ইন্দ্র দৈবাস্ত্র পাঠিয়েছেন, সেগুলি তিনি লক্ষ্মণকে দিয়ে বলেন সে যেন বিভীষণের সঙ্গে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করে মেঘনাদকে বধ করে। দেবী আরও বলেছন, তাঁর কৃপায় তাঁরা অদৃশ্যভাবে যজ্ঞশালায় প্রবেশ করতে পারবেন।
রামচন্দ্র বললেন, যে ভীষণ শত্রুর ভয়ে দেব-নর সকলেই ভীত, সেখানে লক্ষ্মণকে তিনি একা কেমন করে পাঠাবেন? সীতা উদ্ধারের জন্য বৃথা চেষ্টা করে আর লাভ নাই। তিনি রাজ্য সম্পদ, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব সব হারিয়েছেন—বাকি ছিলেন সীতা, সেও রাবণ কর্তৃক অপহৃত, এখন একমাত্র লক্ষ্মণ আছেন, তাকেও যদি যুদ্ধে হারাতে হয়, এই আশঙ্কায় বলেন আর যুদ্ধে কাজ নেই।
রামের এই খেদোক্তিতে লক্ষ্মণ বলেন, দেবতা যেখানে সহায় যেখানে এই খেদ অনুচিত। তিনি যদি রামচন্দ্রের আদেশ পান তাহলে লঙ্কায় প্রবেশ করে মেঘনাদকে বধ করতে সমর্থ হবেন। সুতরাং দেবতাদের ইচ্ছার বিরোধিতা করা ঠিক হবে না। বিভীষণও অনুরূপে বোঝালেন এবং বললেন স্বপ্নে দেবী তাঁকে আদেশ দিয়েছেন মেঘনাদবধ-এ লক্ষ্মণকে সাহায্য করতে। তবুও রামচন্দ্র আশ্বস্তবোধ করেননি। রামচন্দ্রের জন্য যে লক্ষ্মণ রাজ্যে, মা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে এসেছেন সেই লক্ষণের জীবন বিপন্ন করে তিনি কেমন করে সীতা উদ্ধারে পাঠাবেন ? তাই এ চেষ্টায় প্রয়োজন নেই। এমন সময় তিনি দৈববাণী শুনলেন, দেবাদেশ অবহেলা করা অনুচিত। আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখেন সাপ আর ময়ূরের এক যুদ্ধ বেধেছে। যুদ্ধে ময়ূরের মৃত্যু হলে সাপ গর্জন করতে থাকে। বিভীষণ ব্যাখ্যা করে বললেন সাপের কাছে সর্পভক্ষক ময়ূরের পরাজয় ঘটেছে, তার অর্থই হল লক্ষণের হাতে মেঘনাদের মৃত্যু হবে।
রামচন্দ্র আশ্বস্ত হয়ে লক্ষ্মণকে দৈবাস্ত্রে সাজিয়ে দিলেন। লক্ষ্মণ বিভীষণের সঙ্গে দ্রুত অদৃশ্যভাবে যাত্রা করলেন। মায়াদেবী রাক্ষসকুল-রাজলক্ষীর মন্দিরে প্রবেশ করে তাঁর তেজ সম্বরণ করতে অনুরোধ করলেন। রাজপুরলক্ষী মায়াদেবীর সঙ্গে মন্দির ত্যাগ করে লঙ্কার পশ্চিমদ্বারের দিকে গেলেন। লঙ্কায় একের পর এক অঘটন ঘটতে লাগল ।
মায়াবলে লক্ষণের স্পর্শমাত্রে লঙ্কার সিংহদ্বার খুলে গেল, কেউ শব্দ শুনতে পেল না, এবং তাঁদের কেউ দেখতে পেল না। লঙ্কার অপরূপ ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে তাঁরা নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে পৌঁছুলেন—সেখানে নির্জনে বিবিধ উপাচার বেষ্টিত হয়ে মেঘনাদকে ধ্যানে রত দেখতে পেলেন। লক্ষণের অস্ত্রের শব্দে মেঘনাদের ধ্যান ভঙ্গ হল। লক্ষণের রূপ ধরে অগ্নিদেবতার আবির্ভাব ঘটেছে মনে করে। এভাবে তাঁর আবির্ভাবের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে লক্ষ্মণ আত্মপরিচয় দিলেন এবং দেব অসি কোষমুক্ত করে মেঘনাদকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে, মেঘনাদ বললেন, যদি সত্যই তাঁর যুদ্ধে সাধ জাগে তা পূর্ণ করবেন। কিন্তু নিরস্ত্রকে আক্রমণ করা বীরধর্ম নয়, তাই তাকে অস্ত্রসজ্জিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া বিধেয়। লক্ষ্মণ বললেন রাক্ষসের সঙ্গে ক্ষাত্রধর্ম পালন অর্থহীন—শত্রুকে যে কোনো উপায়ে বধ করাই তাঁর উদ্দেশ্য। লক্ষণের এ কথায় মেঘনাদ তার তীব্র নিন্দা করেন । এবং অবশেষে পূজার কোষা তুলে তাকে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করেন। লক্ষ্মণ মূর্ছিত হয়ে পড়লে তাঁর দৈবাস্ত্র কেড়ে নিতে গিয়ে পারলেন না, বুঝলেন এ হোল দেবতাদের ষড়যন্ত্র। দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন শূলধারী বিভীষণকে। বিষণ্নভাবে মেঘনাদ বললেন, এতক্ষণে তিনি বুঝতে পারছেন যে কীভাবে লক্ষ্মণ এখানে প্রবেশ করেছেন। বিভীষণের এ হেন কাজের জন্য মেঘনাদ তাঁর নিন্দা করলেন। পিতৃব্যকে অনুরোধ করলেন পথ ছেড়ে দিতে, তাহলে তিনি অস্ত্রাগারে গিয়ে অস্ত্র নিতে পারেন। বিভীষণ নিজেকে রামচন্দ্রের দাস বলায় মেঘনাদ তাকে ধিক্কার দিলেন। বিভীষণ লজ্জাবনত মুখে বললেন, তাকে ভর্ৎসনা বৃথা, রাবণের পাপের জন্যই সবংশে ধ্বংস হতে চলেছেন। মেঘনাদ তখন বললেন হীন সংসর্গে থাকার জন্যই আজ বিভীষণ এতই অধঃপতিত হয়েছেন যে, জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন।
এদিকে মায়ার য-ে লক্ষ্মণ চেতনা পেয়ে মেঘনাদকে তীক্ষ্ণ শরে বিদ্ধ করতে লাগলেন। মেঘনাদের দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মাটি লাল হয়ে গেল। বেদনায় অস্থির মেঘনাদ একের পর এক পূজা পাত্র লক্ষণের দিকে নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু মায়ার প্রভাবে তা তাঁর গায়ে লাগল না। গর্জন করে লক্ষণের দিকে ধাবিত হলে মায়ার বলে দেখলেন দেবতারা লক্ষ্মণকে আঁড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে হতাশ হলেন। ইত্যবসরে লক্ষ্মণ দৈব-অসি দিয়ে মেঘনাদকে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। পৃথিবী কেঁপে উঠল, সমুদ্র উদ্বেল হল, ভৈরব রবে বিশ্ব পূর্ণ হল। রাজসভায় রাবণের মাথার সোনার মুকুট খসে পড়ল । মন্দোদরী বিনা কারণে মূর্ছিত হলেন, প্রমীলা অকস্মাৎ ভুলে কপালের সিঁদুর মুছে ফেললেন, রাক্ষস শিশুরা কেঁদে উঠল।
মৃত্যুপথযাত্রী মেঘনাদ বললেন তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না, কিন্তু একটি কাপুরুষের হাতে তাঁর মৃত্যু হচ্ছে, এটিই তাঁর দুঃখ। লক্ষ্মণকে দেব-দৈত্য মানব কেউই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারবেন না, তাঁর অপযশ কোনো কালে ঘুচবে না।
মেঘনাদের মৃত্যুতে বিভীষণও শোকার্ত হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। লক্ষ্মণ বিভীষণকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মেঘনাদের মৃত্যুতে বিভীষণের কোনো হাত নেই, বিধির বিধানেই সব ঘটেছে। এখন অনতিবিলম্বে ফিরে গিয়ে রামচন্দ্রের উৎকণ্ঠা দূর করা কর্তব্য। অবশেষে তাঁরা রামচন্দ্রের কাছে ফিরে গিয়ে মেঘনাদ নিধনের সংবাদ দিলে, রামচন্দ্র তাঁদের সাধুবাদ ও বিভীষণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শঙ্করীর পূজা করতে বললেন। আকাশে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন, ‘জয় সীতাপতির জয়’ ধ্বনিতে লঙ্কার অধিবাসীরা সচকিত হল।