গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের কেউ অবৈধভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে সম্পর্ক জটিল ধাঁধায় রূপান্তরিত হয়। সেইসাথে জন্ম নেয় ঘোরতর পাপ। যার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় আমৃত্যু। গ্রিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’। দেবতাদের প্রণীত বিধান, রাজা ইডিপাসের কৃতকর্ম এবং সেই কৃতকর্মের করুণ পরিণতি ‘ইডিপাস’ নাটকের প্লট। ইডিপাসকে শেক্সপিয়রীয় নাটকগুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ নাটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইডিপাস নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র
ইডিপাস (থিবির রাজা), জোকাস্টা (থিবির রাণী), ক্রিয়ন (জোকাস্টার ভাই), লেয়াস (থিবির প্রয়াত রাজা) টিরেসিয়াস (অন্ধ জ্যোতিষী), যাজক, ইসমিনি (ইডিপাসের মেয়ে), আন্তিগোনি (ইডিপাসের মেয়ে) পলিবাস, মেরোপি, করিন্থীয় দূত, থিবির মেষপালক, প্রতিহারী, রাজার পরিচারকবৃন্দ, রাণীর পরিচারকবৃন্দ, থিবির নাগরিকদের কোরাস।
লেখক পরিচিতি : সফোক্লিস
ইডিপাস রচনা করেছেন বিখ্যাত গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৬-৪০৫ অব্দে, এন্সের নিকট কলোনাস গ্রামে। সফোক্লিসের বাবা ছিলেন একজন অস্ত্র নির্মাতা ও সেই গ্রামের একজন জনপ্রতিনিধি। ফলে বলতে পারি একজন ধনী ঘরেরই সফোক্লিস সন্তান ছিলেন।
প্রাচীন গ্রীসের অন্যান্য অভিজাত পরিবারের মতোই সফোক্লিস নৃত্যকলা, কাব্য, শরীরচর্চায় ও সঙ্গীত বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি কূটনীতিক ও সামরিক দিকেও যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সফোক্লিস যুবক থাকাকালীন নৃত্যকলায় ও সঙ্গীতে দক্ষতা দেখিয়েছিেন। এথেন্স সে সময়ে যখন নৌযুদ্ধে পার্সিয়ানদের হারিয়ে জয়ী হয় তখন তিনি একটি কোরাস সঙ্গীত রচনা করে সারা ফেলে দিয়েছিলেন। আর এই কারনে তিনি এথেন্সের সরকারি প্রশাসনিক সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকাকালীন সফোক্লিস গ্রীক শিল্পকলায় যথেষ্ট প্রভাব রাখেন। নাটক লেখার পাশাপাশি সফোক্লিস ছিলেন একজন অসাধারণ অভিনেতা।
নাটক রচনায় সফোক্লিস সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন গ্রীক ট্রাজেডি নাটক রচয়িতা এস্কাইলাসের দ্বারা। সময়ের সাথে তিনি এস্কাইলাস কেও অতিক্রম করে যান। ৪৬৮ খৃস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের নাট্যকলা প্রতিযোগিতায় ট্রাজেডি নাটক রচনা করে তিনি প্রথম পুরষ্কার জিতে নেন।
খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী ছিল গ্রীক নাটকের সোনালী অধ্যায়। ট্রাজেডি নাটক রচয়িতা হিসেবে সফোক্লিস ছিলেন সেকালে একেবারে তুঙ্গে। সফোক্লিস কে বলা হয় গ্রীক ট্রাজেডি নাটকের সার্থক স্রষ্টা।
সফোক্লিসের বিখ্যাত নাট্যকর্মের মধ্যে এন্টিগোনে, অ্যজ্যাক্স, ইডিপাস দি কিং, ইলেক্ট্রা, ইডিপাস অ্যাট কলোনাস অন্যতম। জীবদ্দশায় সফোক্লিস ১২০ টির মত নাটক রচনা করেছিলেন।
এথেন্সের অভিজাত মহল থেকে সাধারণ দর্শক সকলে সফোক্লিসের নাট্যকর্মের অনুরাগী ছিলেন।
সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ কেন ট্রাজেডি নাটক?
ট্র্যাজেডি’ বলতে আমরা বুঝি বিয়োগান্তক নাটক । গ্রীক শব্দ ‘Tragoidia’ থেকে Tragedy শব্দটির উৎপত্তি। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘goat song ‘ বা ছাগগীতি । (গ্রীক Tragodia থেকে লাতিন Tragoedia, তার থেকে মধ্যযুগীয় লাতিনে Tragedia এবং তার থেকে মধ্যযুগীয় ইংরেজিতে Tragedie)। এই Tragedie -ই আধুনিককালে Tragedy হয়েছে। ট্রাজেডির উৎপত্তি গ্রীসে। গ্রীসের দেবতা ডায়োনিসাস (Dionysus) এর পুজো উপলক্ষে ছাগ বা ভেড়া বলিদান উৎসব হত। বসন্তের এই উৎসবে গায়কেরা ভেড়ার চামড়ায় সারা শরীর ঢেকে আনুষ্ঠান করত। গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল নাট্যকাহিনী।
সে সময় গ্রীস দেশে নাট্যভিনয়ের প্রতিযোগিতা হত এবং সেই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ্য নাট্যকারকে ‘ছাগ’ পুরস্কার দেওয়া হত। পেয়েটিকস’ গ্রন্থে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি কাকে বলে তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্দেশ করে বলেছেন –
Tragedy, therefore, is a replication of a serious and comprehensive action, possessing a certain magnitude, conveyed through language adorned with various artistic embellishments distributed throughout the play. It is presented in the form of action rather than mere narration, eliciting feelings of pity and fear, ultimately leading to the proper purging – catharsis – of these and akin emotions.
সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাসের মতে,“আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত বা অভিভূত মানবজীবনের বিষাদাত্মক করুন কাহিনী কে ট্রাজেডি বলা হয়। “
ট্রাজেডির নাটকের বৈশিষ্ট্য :
১. ট্র্যাজেডির বিষয় হবে গুরুগম্ভীর বা serious ঘটনার অনুকরণ।
২. ট্র্যাজেডি হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
৩. ট্র্যাজেডির প্লট হবে বৃত্তাকার ও সুগঠিত।
৪. কাহিনী হবে আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত।
৫. ট্র্যাজেড়িতে ত্রিঐক্য থাকবে অর্থাৎ স্থান, কাল ও পাত্রের ঐক্য থাকবে।
৬. ঘটনাগুলির বর্ণনা দেখাতে হবে নাটকীয় রীতিতে।
৭. নাটকে বিভিন্ন ঘটনা থাকবে এবং তবে ঘটনাবলির পরিণাম হবে একমুখী।
৮. নায়কের উপরে নেমে আসা বিষাদময় ঘটনা দর্শকমনে করুনা ও ভীতির (Pity ও fear) সৃষ্টি করবে। এর ফলে দর্শকদের Catharsis বা ভাবমোক্ষণ ঘটবে।
৯. ট্র্যাজেডি সমৃদ্ধ অলংকারে সাজা হবে, নাটকের প্রতিটি ভাগে সেই অলংকার ভাষা ব্যবহার করা হবে।
১০. ট্র্যাজেডির ভাষা, সংলাপ, ও সংগীত হবে ভাবগম্ভীর।
১১. ট্র্যাজেডির রস হবে ভীতিজনক করুণ।
১২. ট্র্যাজেডি জীবনকে অনুকরণ করবে।
ট্রাজেডির উপাদান :
অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিক্স্ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ট্র্যাজেডি নাটকের উপাদান কি কি তা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন এবং তাদের পারস্পরিক গুরুত্বের কথাও বলেছেন।
অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি নাটকের ছয়টি উপাদান এর কথা বলেছেন । এগুলো হলো :
কাহিনী বা বৃত্ত (Fable or Plot),
চরিত্র (Character)
বাচন (Diction),
মনন (Thought),
দৃশ্যসজ্জা (Spectacle), এবং
সংগীত (Music)।
ইডিপাস নাটকের কাহিনী, ইডিপাস নাটকের বিষয়বস্তু, ট্রাজেডি, শিল্পমূল্য ও নাটকের গঠন কৌশল বিচার:
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ল্যাবডেকের পুত্র লেয়াস হলেন থিবীসের রাজা। লেয়াসের স্ত্রীর নাম জোকাস্টা। লেয়াস, যিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি সন্তান কামনা করেছিলেন, গোপনে ডেলফির মন্দিরে গিয়েছিলেন তার নিঃসন্তান হওয়ার কারণ জানতে। দৈববানী এলো, এই সন্তানের অনুপস্থিতি দুর্ভাগ্য বা অভিশাপ নয়, এটি একটি আশীর্বাদ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। কারণ রানী জোকাস্টার সন্তান একদিন তাকে মেরে ফেলবে। রাজা লেয়াস জোকাস্টাকে না বলে জোকাস্টা থেকে দূরে ছিলেন।
জোকাস্টা বিভিন্ন কৌশলে রাজাকে প্রভাবিত করে এবং একটি সন্তান ধারণ করে। নয় মাস পর রানী একটি সন্তানের জন্ম দেন। রাজা লেয়াস নবজাতক শিশুটিকে রানীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাহাড়ের এক নির্জন স্থানে তাকে হত্যা করার জন্য এক রাখালকে দিয়েছিলেন। নবজাতকের পা লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় যাতে সে মারা যায়। কিন্তু ভাগ্য তার বিপক্ষে ছিল। বেঁচে যায় নবজাতক শিশুটি।
ইডিপাস শব্দের অর্থ হচ্ছে “ফুলে যাওয়া পদযুগল”। মেষ পালক তাকে নিয়ে এল করিন্থে। সে সময় করিন্থের শাসক ছিলেন রাজা পলিবাস। রাজা পলিবাস ও তার রানী মেরোপীরও কোন সন্তান ছিল না। তাই তারা নবজাত শিশুটিকে গ্রহণ করে নিজ সন্তানের মত লালন পালন করতে লাগলেন। একদিন করিন্থের এক যুবক ইডিপাসকে উপহাস করে বলল, সে তার পিতা মাতার মত নয় দেখতে। ইডিপাস মনে সন্দেহ নিয়ে গেল অ্যাপলোর মন্দিরে। দৈববাণী তে তাকে জানানো হল, সে তার পিতাকে হত্যা করবে, নিজ মাতাকে বিবাহ করবে।
হতাশা আর ব্যথা বেদনায় ভেঙ্গে পড়ল ইডিপাস, এ দৈববাণী কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য ইডিপাস পালক পিতা কে আপন পিতা ভেবে করিন্থ ত্যাগ করলেন। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে সে করিন্থ হতে বেশ দূরে কোসিস নামক স্থানের একটি তেমাথা পথের মোড়ে এল। সে সময় একজন বৃদ্ধ রাজপুরুষ রথে আরোহণ করে যাচ্ছিলেন পরিচারক বর্গসহ। ইডিপাসকে রাস্তা ছেড়ে দিতে বলল। কিন্তু ইডিপাস মোটেই পথ থেকে সরে যাবেন না। শেষে রাজপুরুষ রথ চালনা করার নির্দেশ প্রদান করলেন। ধাবমান রথের চাকায় ইডিপাসের পা থেতলে গেল, ইডিপাস ক্রোধে দিশেহারা হয়ে রাজপুরুষ ও তার পরিচারকদের হত্যা করলেন। শুধু একজন অনুচর কোনরকম প্রাণে রক্ষা পেয়ে থিবীসে এসে জানাল লোকজনসহ রাজা লেয়াস দস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন। দস্যুদলের কথাটা সে একটু বাড়িয়ে বলেছিল।দৈববাণীর প্রথম অংশটুকু সে কার্যকর করে ফেলেছে ইডিপাস ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না। এরই মাঝে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এটা সত্যি হল।
সে সময় থীবিসের জনগণ ‘স্ফিংস’ (দেহের উপরের অংশ নারী এবং নিচের অংশ সিংহের এমন দেহধারী) নামক এক দানবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একাকী কোন পথচারীকে সামনে পেলে স্ফিংস একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। ধাঁধার জবাব না দিতে পারলে পথচারীকে সে হত্যা করতো।
রাজা লেয়াসকে হত্যা করার পর ইডিপাস থিবীসের দিকে যেতে থাকে। পথিমধ্যে সে স্ফিংসের কবলে পড়ে। স্ফিংস তাকে জিজ্ঞেস করে : বল দেখি , এমন কোন প্রাণী আছে পৃথিবীতে যে সকালে চার পায়ে হাঁটে,দুপুরে দু’পায়ে হাঁটে আর বিকেল বেলায় হাঁটে তিন পায়ে?
ইডিপাস জবাব দিলেন, সে প্রাণী হচ্ছে মানুষ। শৈশবে হামাগুড়ি দেয়, যৌবনে দু’পায়ে হাঁটে আর বৃদ্ধকালে দু’পা আর একটি লাঠি এই তিন দ্বারা হাঁটে।
স্ফিংস তার জবাব শুনে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হয়। কারণ এটাই ছিল তার নিয়তি। স্ফিংসের মৃত্যুতে নিশ্চিন্ত ও কৃতজ্ঞ থিবীসের জনগণ ইডিপাসকে তাদের রাজা হিসেবে বরণ করে নিল। ইডিপাস কেন তার মাকে বিয়ে করেছিলেন? ইডিপাস থিবীসের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রচলিত দেশাচার অনুযায়ী রাজার বিধবা স্ত্রী জোকাস্টাকে বিয়ে করল। ইডিপাস জানতেও পারল না যে এই জোকাস্টাই তার গর্ভধারিণী মাতা।
এরপর পার হয়ে গেল দীর্ঘ ১৫ টি বছর। থীবীসের রাজ্যভার গ্রহণ করে ইডিপাস যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় প্রদান করেছে দেশ শাসনের ক্ষেত্রে, এ কারণে সে রাজ্যের সবার কাছে প্রিয়। আর রানী জোকাস্টাকে রানী হিসেবে পেয়েও সে তৃপ্ত। এরই মাঝে ইডিপাস ও রানী জোকাস্টার চারটি ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। দুই পুত্র একজনের নাম ইটিওক্লিস,অন্য জনের নাম পলিনিসেস। দু’মেয়ে এন্টিগোনে ও ইজনীনি । ইডিপাস ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না যে, সে তার নিজ মাতার শয্যাসঙ্গী হয়ে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছে।
ইডিপাস তখন রাজা হয়ে রাজ্য শাসন করছেন দীর্ঘদিন। হঠাৎই তার রাজ্যে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ আর সাথে মহামারী। থিবির রাজা ইডিপাস রাজপ্রাসাদের সামনে বিনীত ভঙ্গিতে বসে ছিলেন। রাজ্যের সকল প্রজা সমবেত হলো রাজপ্রাসাদের সামনে। প্রজারা তার কাছে আসে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে রাজার সাহায্য চাওয়ার জন্য। তারা রাজাকে বলছেন কোনো এক অদৃশ্য কারণে রাজ্যে ফসল উৎপন্ন হচ্ছে না, রমণীদের গর্ভে সন্তান আসছে না, প্লেগ মহামারিতে মানুষ মরছে অগণিত। এভাবে চলতে থাকলে রাজ্য তো গোরস্থান হয়ে যাবে। রাজা ইডিপাস প্রজাদের সেসব কথা শুনে ব্যাথিত হন। অধিবাসীদের বেদনায় বেদনার্ত ইডিপাস বলেছেন :
‘তোমরা আমার সন্তান, আমি তোমাদের জন্য বেদনার্ত। তোমাদের যন্ত্রণা আমিও অনুভব করি কিন্তু তোমরা যেখানে বহন করছে আপন আপন বেদনা আমি সেখানে বহন করছি সর্বজনের বেদনা। এদেশের সকল মানুষের বেদনা।’
কোন কারণে তার রাজ্যে এমন মরক লেগেছে তা জানার জন্য সাথে সাথেই তার শ্যালক ও পরামর্শদাতা ক্রিয়নকে ডেলফির মন্দিরে পাঠান দৈববাণী জানার জন্য। ক্রিয়ন ডেলফির মন্দির থেকে দৈববাণী নিয়ে ফেরত আসে এবং ইডিপাস কে ক্রিয়ন সে দৈববাণী একান্তভাবে জানাতে চাইলে সে কথা প্রত্যাখান করে এবং তাকে সে কথা সবার সামনে বলতে বলে। ক্রিয়ন বলে এই রাজ্যের আগের রাজা লেয়াস কে যে হত্যা করেছে, সে এই রাজ্যেই অবস্থান করছে আর সে মহাপাপ লালন করছে। তার এই মহাপাপের জন্যই আজ রাজ্যের এই দুর্ভিক্ষ ও মহামারী।
ইডিপাস তারপর শুরু করেন তদন্ত কে খুন করেছে রাজা লেয়াস কে?
‘আমি নতুন করে সন্ধান করবো। সমস্ত কিছু দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হবে। দেবতার জন্য, আমাদের দেশের জন্য আমি তোমাদের সহায়ক বন্ধু হিসেবে কাজ করব। কলঙ্কিত হত্যার প্রতিশোধ আমি নেব ।’
এজন্য তিনি অন্ধ জ্যোতিষী টেরেসিয়াস কে ডেকে পাঠান। টেরেসিয়াস ইডিপাস কে সত্যি জানতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ইডিপাস নাছোর বান্দা, সে সত্য জেনেই ছাড়বে। টেরেসিয়াস ইডিপাস কে বলে এই সত্যি প্রকাশ করলে ইডিপাসেরই ক্ষতি হবে।
আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই, তুমি ক্রমান্বয়ে সুনিশ্চিত ভয়াবহতার সাথে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছো।
টিরোসিয়াস আরো বলেন,‘দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও তুমি তোমার সর্বনাশ দেখতে পারছো না! ‘
কিন্তু ইডিপাস টেরেসিয়াস এর কথা পাত্তা না দিয়ে তাকে কঠোর ভাবে তিরস্কার ও হুমকি দিতে থাকেন, সাথে তাকে মৃত্যু ভয় ও দেখান।
এটা আমার বিশ্বাস, লেয়াসের হত্যার ষড়যন্ত্রে আপনিও জড়িত ছিলেন।
টেরিসিয়াস তখন বাধ্য হয়ে বলেন, যে রাজা লেয়াস কে হত্যা করেছে সে লেয়াসেরই বিধবা স্ত্রী অর্থাৎ নিজের মাকেই বিয়ে করে এই রাজ্য শাসন করছে। এই রাজা ইডিপাসই লেয়াসের খুনি। সেই রাজ্যের মহামারী ও দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী।
তুমি তোমার নিকটতম আআত্মীয়ের সঙ্গে পাপের মধ্যে বাস করছো।তুমি এদেশের মহামারী ও মন্বন্তরের কারণ, তুমি এদেশকে অপবিত্র ও লাঞ্ছিত করছো।
এসব শুনে ইডিপাস ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। তিনি বলেন এ সব কিছুই ক্রিয়নের ষড়যন্ত্র। ক্রিয়ন এই অন্ধ টেরেসিয়াস কে শিখিয়ে পড়িয়ে এসব আজগুবি কথা বলাচ্ছে যেনো তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে ক্রিয়ন নিজে সিংহাসনে বসতে পারে। এরপর শুরু হয় ক্রিয়ন ও ইডিপাসের মধ্যে বাকবিতণ্ডা। ইডিপাস সিদ্ধান্ত নেয় ক্রিয়নকে নির্বাসনে পাঠানোর।
তুমি কি ভেবেছো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিন্তে বেঁচে যাবে। তোমার প্ররোচনা না পেলে সে আমাকে লেয়াসের হত্যাকারী বলত না।
রাণী জোকাস্টা ইডিপাস কে শান্ত করার চেষ্টা করে। এবং বুঝায় সে রাজাকে খুন করতে পারেই না। কারণ রাজার পুত্রসন্তান কে রাজা অনেক বছর আগে পাহাড়ের পাদদেশে ফেলে রেখে হত্যা করেছে। আর রাজা খুন হয়েছিল দস্যুদের হাতে। এটা রাজ্যের সবাই জানে।
এসব কথা শুনে ইডিপাস চমকে উঠে। কারণ এই রাজ্যে ঢোকার মুখেই সে একজন রাজপুরুষসহ কয়েকজন পেয়াদাকে হত্যা কারেছিল।
ইডিপাস তখন মারিয়া হয়ে উঠে তার জন্মরহস্য জানার জন্য। রাণী জোকাস্টা অনেক নিষেধ করে বলে “বেশি সত্য জানা ভালো ব্যাপার নয়।” কিন্তু ইডিপাস নাছোরবান্দা, সে সত্য খুঁজে বের করবেই।
জোকাস্টা কে বলেছেন ,“সন্ধানের সমস্ত সূত্র এখন আমার হাতের মুঠোয়, আমি আমার জন্মের সত্য আবিষ্কার করবই।”
জন্ম রহস্য উন্মোচনে রাণী জোকাস্টা তাকে বাধা দিলে ইডিপাস ভেবেছেন,
“ আমার জন্ম খুব নিচু ঘরে হতে পারে, কিন্তু তাও আমি জানতে চাই। রাণীর গর্বে আঘাত লেগেছে তিনি ভাবতে চান না যে তার স্বামী রাজবংশের নয়, এ সত্য আবিষ্কারে আমার কোন লজ্জা নেই। ”
অন্যদিকে, লেয়াসের হত্যাকারীর সন্ধানে রত রাজা ইডিপাস, জোকাস্টার ভ্রাতা ক্রীয়ন এবং ত্রিকালদর্শী অন্ধ মহাপুরুষ টিরেসিয়াসের মধ্যে যখন বাকবিতণ্ডা শুরু হলো তখন নগরবৃদ্ধরা তাদের শান্ত করতে চাইল, কিন্তু কেউ শান্ত হওয়ার নয় । এ সময় রানি জোকাস্টা এসে সব কথা শুনে তাদের নিরস্ত হতে বলেছেন, “তোমাদের কী কোথাও বিবেচনা নেই? দেশের চরম দুর্দশার সময় ব্যক্তিগত বিরোধকে বড়ো করে তুলছ।” ক্রীয়নের প্রতি ইডিপাসের অবিশ্বাস দেখে রানি বলেছেন, “ক্রীয়ন শপথ নিয়েছে। দেবতার নামে যে শপথ নেয়া হয়েছে, শপথের অমর্যাদা কর না। তাকে বিশ্বাস কর ইডিপাস।”
জোকাস্টা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, ইডিপাস, যার সাথে সে সংসার করছে সে তার স্বামী নয়, গর্ভে ধারণ করা তারই আপন পুত্র; যাকে ছোটবেলায় হত্যা করার জন্য মেষপালকের কাছে দেওয়া হয়েছিল। তাই জোকাস্টা তার সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে ইডিপাসকে ক্ষান্ত হওয়ার জন্য মিনতি জানালেন, “তুমি সর্বনাশ কর না। আর কিছু জানবার চেষ্টা কর না। আমি আবার বলছি আর জানতে চেয় না।” কিন্তু ইডিপাসকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না। জোকাস্টা বুঝতে পারলেন সত্য উদ্ঘাটিত হবে। এক অস্থির উন্মাদনা নিয়ে প্রাসাদ অভ্যন্তরে যাওয়ার আগে তিনি চিৎকার করে বললেন, “অন্ধ- তুমি অন্ধ! হায়রে দুর্ভাগা! তুমি যেন কখনো না জানো তুমি কে?”
এমন সময় করিন্থ থেকে দূত এসে জানায় রাজা পলিবাস মৃত্যুবরণ করেছে। সে রাজ্যের সবাই ইডিপাস কেই তাদের পরবর্তী রাজা বানাতে চায়। কিন্তু ইডিপাস দৈববাণী শুনেছে সে তার মাতাকেই বিয়ে করবে। ফলে ভয়ে, ইডিপাস আর রাজ্যে যেতে চায় নি, কারণ তখনো জীবিত রাণী মেরোপি।
ভাগ্যের চক্রে আবর্তিত ইডিপাস অজ্ঞাতেই ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছেন। করিন্থের রাজদূত জানাল, ইডিপাসের কোন ভয় নেই কারণ সে পলিবাসের আসল পুত্র নয়। তাকে পলিবাসের মেষপালক সিথেরন পাহাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ইডিপাস এবার সেই মেষপালককে খুঁজে আনার নির্দেশ দিল।
মেষপালক কে খুজে পাওয়া গেলো সে ততোদিনে ষাটোর্ধ বুড়ো। সে ইডিপাস কে অনেক অনুনয় করে যে সত্য বলতে পারবে না এতে ইডিপাসেরই ক্ষতি হবে। ইডিপাস জোর করতে থাকে তাকে সত্য বলার জন্য। তখন সেই বৃদ্ধ মেষপালক তার অতীত বলতে শুরু করে। সে জানাল ইডিপাসই রাজা লেয়াসের পুত্র। এসব কথা রানী জোকাস্টা, রাজ্যের প্রজা ও কর্মী সকলের সামনে এই সত্য প্রকাশ হয়।
ইডিপাস বুঝল যে, তিনি তার পিতাকে হত্যা করে তার মাতা রানী জোকাস্টাকে বিয়ে করেছিলেন। এটা প্রকাশ পাওয়ায় রানী জোকাস্টা খুবই দুঃখিত হন এবং লজ্জিত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
আর রাজা ইডিপাস তার কৃত পাপকর্মের জন্য কাটা দিয়ে নিজের দু’চোখ উপড়ে ফেলে নিজেকে অন্ধ করে দিল। তার দুই চোখে বৃষ্টির মতো রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে, আর ইডিপাস নির্মম যাতনায় চিৎকার করে বলতে থাকেন “যখন চারদিকে কদর্য বীভৎসতা, তখন এ চোখ দিয়ে আমি কী করব?” শুধু তাই নয়, লেয়াসের হত্যাকারীর প্রতি তিনি যে কঠোর দণ্ড নির্দেশ দিয়েছেন তাই স্বেচ্ছায় মেনে নিলেন। ক্রীয়নের প্রতি তাঁর শেষ অনুরোধ, “এ মুহূর্তে এদেশ থেকে আমাকে নির্বাসন দাও। শৈশবে আমার পিতামাতা সিথায়েরন পর্বতে আমার মৃত্যু চেয়েছিলেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা আমি পূর্ণ করব। আমি সেখানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করব।”
মৃত্যু নয়, মৃত্যুর অনুভূতিই ট্র্যাজেডি। ইডিপাস শুধু মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন নি, মৃত্যুকে অনুভব ও উপলব্ধি করেছেন। অনুভূতির তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় এবং পাপের শাস্তি গ্রহণ ও স্বীকার করার মধ্য দিয়ে ইডিপাস আপনাকে আপনি অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর অতল গভীর বেদনা ও বীর্যবত্তা তাকে অসাধারণ মহিমায় দেদীপ্যমান করেছে। ইডিপাস হয়ে উঠেছেন ট্র্যাজিক নায়ক।
ইডিপাস ও জোকাস্টার পাশাপাশি অপ্রধান চরিত্র ক্রীয়নের সাক্ষাৎ লাভে নাটকীয় ঘটনা আরো চমকপ্রদ হয়েছে। ভয়ংকর ঘটনাবলির মধ্যে বেপরোয়াভাবে টেনে আনা হয়েছে সে নাগরিকদের। ক্রীয়ন ছিলেন ইডিপাসের সত্যিকার বন্ধু ও কল্যাণকামী স্বজন। তাই নাটকের শেষে আমরা দেখি ইডিপাস যখন মহাসর্বনাশের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, সেই চরম দুঃখের দিনেও ক্রীয়ন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং সর্বস্বান্ত ইডিপাসকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, “ইডিপাস, তোমার পতন দেখে পরিহাস করতে আমি এখানে আসি নি, তোমার পাপের জন্য তোমাকে অপরাধী করতে আসি নি।”
ইডিপাসের স্থলে ক্রীয়ন থিবিসের রক্ষাকর্তার আসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ইডিপাসের বেদনায় সমব্যথী হয়ে ঘোষণা করেন, “পৃথিবী অথবা বাতাস অথবা পানি কোনো অপবিত্রকে গ্রহণ করবে না। একে ভিতরে নিয়ে যাও; অন্য কেউ নয় শুধু রক্ত সম্পর্কীয়রাই তার সামনে থেকে তার আর্তনাদ শুনবে এবং তার যন্ত্রণাকে দেখবে।”
আর সাথে সে তার শ্যালক ও মামা ক্রিয়নের কাছে খারাপ ব্যাবহারের জন্য ক্ষমা চায়। ক্রিয়ন তাকে নির্বাসনে না পাঠিয়ে প্রাসাদেই বন্দী করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রিয়নের কাছে ইডিপাসের শেষ অনুরোধ তাকে যেন রাজ্য হতে নির্বাসন দেওয়া হয়। জবাবে ক্রিয়ন বলেছে, “ অবশ্যই তা হবে কিন্তু দেবতার নির্দেশের অপেক্ষায় আমি আছি ”
লেয়াসের হত্যাকারীর প্রতি ইডিপাস যে কঠোর দণ্ড নির্দেশ দিয়েছেন তাই তিনি স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া, পাপের শাস্তি গ্রহণ ও স্বীকার করার মধ্যে এবং অনুভূতির তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় ইডিপাস আপনাকে আপনি অতিক্রম করে গেছেন।
ইডিপাস যে স্থির দৃঢ়তা ও বীর্যবত্তার সাথে ভাগ্যকে গ্রহণ ও স্বীকার করেছেন, এর মধ্যে মনুষ্যশক্তির মহিমা বিকশিত হয়েছে। আর তাই এটা আমাদের আনন্দ ও আশ্বাস দান করে। ট্র্যাজেডিতে শক্তিধর মানুষের মহিমা ঘোষিত হয়ে থাকে। এ নাটকে ইডিপাসের মাধ্যমে এ মহিমাই প্রকাশিত হয়েছে। ইডিপাসের নিদারুণ বেদনা আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। ইডিপাস তাঁর অসহায় কল্যাণের কথা ভেবে যখন ব্যাকুল হন তখন তাঁর বেদনায় আমরা সমব্যথী হই। “আমার মেয়েরা? আমাকে ছাড়া তারা কি করে বাঁচবে। ক্রীয়ন, ওদের প্রতি লক্ষ্য রেখ? যদি একবার ওদের স্পর্শ করতে পারতাম, কাঁদতে পারতাম।”
ইজনীনি এবং এন্টিগোনী ইডিপাসের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে তিনি বিহ্বল হয়ে বলেছেন, “তোমরা বড়ো হলে বুঝবে কেন আমি আমার পৃথিবীকে অন্ধকার করেছিলাম। বড়ো হয়ে প্রার্থনা কর, তোমাদের শান্তি ও নিশ্চিন্তায় জীবন কাটুক। আমার অকল্যাণ যেন তোমাদের স্পর্শ না করে।” ইডিপাসের এসব উক্তি আক্ষেপ উক্তি নয়, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ইডিপাস ভালোবেসেছেন বলেই তার অন্তর এত কোমল, এত কাতর। তাঁর কাতরতায় দুর্বল ও অক্ষমের শক্তিহীনতা নয়, শক্তিমানের মহিমাই ঘোষিত হয়েছে।
ইডিপাস নাটকে কোরাসের ভূমিকা রয়েছে। ট্র্যাজেডিতে শক্তিধর মানুষের বীর্যবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই ইডিপাসের বীর্যবত্তা আমাদের মুগ্ধ করে। সেই সাথে তার সহনশীলতা দেখে আমাদের প্রতীতি জন্মে যে, ভাগ্য বিরূপ হলেও ইডিপাস স্বীয় ইচ্ছাশক্তি ও কর্মস্পৃহায় বলীয়ান হয়ে সেই ভাগ্যকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তাঁর ট্র্যাজিক বেদনা হর্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। ইডিপাসের ট্র্যাজেডি দেখে মানবীয় শক্তির প্রতি আমাদের প্রত্যয় জাগে এবং আমরা মানব মহিমা সম্পর্কে আশ্বস্ত হই। তাই ট্র্যাজেডি আমাদের দুঃখের বিমোক্ষণ হলেও ট্র্যাজেডির বেদনা আমাদের আনন্দ দেয়।