জাক দেরিদা বিংশ শতাব্দীর একজন ফরাসি দার্শনিক। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর চিন্তাশীল মনিষীদের মধ্যে তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তার প্রবর্তিত তত্ত্ব ডিকন্সট্রাকশন (অ-নির্মাণ বা বিনির্মাণ) নামে অভিহিত।
দেরিদার চিন্তা ও বিশ্লেষণ উত্তরাধুনিক দর্শনের সাথে জড়িত এবং তার দার্শনিক অভিমুখ উত্তর কাঠামোবাদী (post-structuralist) কাজ হিসেবে পরিগণিত। দেরিদা তার বিভিন্ন বক্তবব্যে ও লেখায় কাঠামোবাদের (structuralism) নানা দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপর্যাপ্ততা চিহ্নিত করেন।সৃষ্ট কোনও তত্ত্বকে চিরন্তন সত্য মনে করে স্থির বসে থাকলে আমরা কোনোদিনও সত্যে উপনীত হতে পারি না। তাই আগের তত্ত্বগুলো খারিজ করে আমাদের নিয়ত নতুন তত্ত্বের এষণায় থাকতে হয়। মোটামুটি এ-ই হলো দেরিদার চিন্তার সারাৎসার।
দেরিদা দেখান:
* প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ হতে পারে
* সেই অর্থগুলো পরস্পর-বিরোধী হতে পারে
* একই বাক্যের নানা ব্যাখ্যার পরস্পর-বিরোধিতা কমানোর উপায় নেই
* তাই ব্যাখ্যা-মূলক পাঠের সীমাবদ্ধতা আছে- এটাকে এপোরিয়া বলে
ডিকনস্ট্রাশনের মূলে আছে ডিফারেন্স (Différance)। এ তত্ত্ব অনুযায়ী: একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই- একটি শব্দের অর্থ তার কাছাকাছি সে সমার্থক শব্দগুলো আছে, তার সাথে পার্থক্য করে নির্ণয় করতে হয়। বাড়ি শব্দটির অর্থ নির্ণয় করতে আমদের দেখতে হবে কীকরে এই শব্দটি ঘর, গৃহ, বাটিকা, প্রাসাদ, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের থেকে আলাদা।
যেহেতু প্রতিটি শব্দ একটি ইমেজ বা ছবি (আসল বা এবস্ট্রাক্ট)’র প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু বাড়ির সাথে গৃহ, বাটিকা, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের পার্থক্য নিরূপণ করতে, একই সাথে সমার্থক শব্দগুলোর ইমেজ, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও ভাবতে হবে।
দেরিদা তার বিভিন্ন বক্তবব্যে ও লেখায় কাঠামোবাদের (structuralism) নানা দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপর্যাপ্ততা চিহ্নিত করেছেন। মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার প্রভাব রয়েছে। দর্শন, সাহিত্য ছাড়াও আইন নৃতত্ত্ব, ইতিহাস-রচনা, ভাষাতত্ত্ব, সামাজিক-ভাষাতত্ত্ব, মনোঃসমীক্ষণ, রাজনৈতিক তত্ত্ব, ধর্মগবেষণা, নারীবাদ, সমকামিতা গবেষণায়ও তার প্রভাব আছে।
দেরিদা ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই তৎকালীন ফ্রান্স অধ্যুষিত আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স নগরীর এল বিয়ার শহরতলিতে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে মুসলিম-প্রধান আলজিরিয়ায়। ছাত্রজীবনেই রুশো, নিৎসে, সার্ত্র, কামু ইত্যাদির পাঠ সেরে ফেলেন। সরবোন, কলম্বিয়া, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থিতু হন। এখানেই তিনি আমৃত্যু মানববিদ্যার অধ্যাপনা করেন। তিনি রলাঁ বার্থ, জাক লাকাঁ, লুসিয়ঁ গোল্ডমান, জঁ-পল ভেরনা, ত্রিস্তান তোদোরব এবং জঁ ইপ্পোলিত – প্রমুখ নামজাদা বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবীদের সমসাময়িক বা সান্নিধ্যধন্য।
সামাজিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দেরিদা আর বিনির্মাণ (ডিকনস্ট্রাকশন) সমার্থক। দেরিদা মূলত কাজ করেছেন ভাষা নিয়ে। ‘মানববিদ্যার চিহ্ন ও ক্রীড়া’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে জাক দেরিদা বিশ্বদরবারে ব্যাপক স্বীকৃতি
লাভ করেন। ষাটের দশকে কাঠামোবাদের পরিবর্তিত রূপ উত্তর-কাঠামোবাদ তাত্ত্বিকদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আর এতে দেরিদার অবদানই সর্বাধিক।
কিছু সমালোচকের মতে Speech and Phenomena (1967) তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্যান্য কাজের মধ্যে Of Grammatology, Writing and Difference, and Margins of Philosophy তার উল্লেখযোগ্য কাজ। ২০০৪ সালের ৯ অক্টোবর এই মহামনীষী প্যারিসে মৃত্যু বরণ করেন।
দারিদার বিনির্মাণতত্বের সারৎসার এক জায়গায় করলে দাঁড়ায়:
ক) বিনির্মাণতত্ব বহুরৈখিক মাত্রার ফলাফল;
খ) আসল সত্য জানা অসম্ভব;
গ) প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ থাকতে পারে এবং সেগুলো পরস্পর বিরোধী হতে পারে;
ঘ) এই পরস্পর বিরোধী মাত্রাগুলো একজায়গায় এনে সরল কিছু করার সুযোগ নেই;
ঙ) ব্যখ্যামূলক পাঠের মধ্যে আছে ধাঁধা যেগুলোকে বলে অ্যাপরিয়া, এই অ্যাপরিয়াই বিনির্মাণবাদের মূল প্রেরণা।