বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ ”বীর্যবতী নারী”। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে ধর্ষিত নারীদের বীরঙ্গনা খেতাব প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান “পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের যথাযোগ্য সম্মান এবং মর্যাদা” দেবার জন্য বাংলাদেশকে আহ্বান জানান এবং বীরাঙ্গনাদেরকে নিজের মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে তেমন একটা গল্প-উপন্যাস নেই। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কথা বলতে এখনো মানুষের কত দ্বিধা, কত অস্বস্তি। এজন্যই হয়তো শাহীন আখতার রচনা করেছেন ‘তালাশ’ উপন্যাসটি। যেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ অবধি এক বীরাঙ্গনা নারীর সন্ধান করেছেন।
‘তালাশ’ উপন্যাসের মূলবিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। সেসব মানুষ, যারা বিক্ষত, বিপর্যস্ত, উন্মুল, অভিঘাতস্নাত, বিক্ষুব্ধ এবং জেদী। তাদের খোঁজ পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের আঠাশ থেকে ত্রিশ বছর পর – এ সময়ের পরিধিতে।
লেখক পরিচিতি
শাহীন আখতারের লেখনশৈলীতে একধরনের ঘোরলাগা ভাব আছে। অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে লেখা সেই লেখনশৈলীতে পাঠককে যেন এক চক্রযানে আটকে ফেলেন তিনি। সেজন্যই গল্পের গভীরে ডুবে যেতে খুব একটা সমস্যা হয় না পাঠকের। তবে পাঠকভেদে এই চক্রযানে আটকাতে খানিকটা সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এই চক্রযানের মূল ইন্ধন অর্থাৎ, লেখিকার লেখনশৈলী অত্যন্ত চমৎকার। সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এবং উপমার ব্যবহার পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে। আবার, এখানেও পাঠকভেদে অনেক বর্ণনাই অনেকের কাছে বাহুল্য বলেও মনে হতে পারে। যদিও গল্প বলার ছলে লেখিকা কেবল তার মনের ভাষাই ব্যক্ত করে গেছেন।
লেখিকা শাহীন আখতারের জন্ম কুমিল্লায়। লেখাপড়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লেখালেখির পাশাপাশি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণেও তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে । নব্বই দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন তিনি। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে ফিকশনের চাইতে নিরীক্ষাধর্মী লেখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।
- ২০০৪ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘তালাশ’ উপন্যাসটি ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ পুরস্কার অর্জন করে নেয়।
- পরবর্তী সময়ে তার রচিত ‘ময়ূর সিংহাসন’ উপন্যাসটির জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
- এছাড়াও, তার অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার এবং এবিপি আনন্দ থেকে ‘সাহিত্যে সেরা বাঙালি’ সম্মাননা প্রাপ্তি।
- ২০১১ সালে উপন্যাসটি দিল্লীর জুবান পাবলিকেশন্স থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ইংরেজিতে নামকরণ করা হয় ‘দ্য সার্চ’ নামে। বইটির অনুবাদ করেন এলা দত্ত।
- ২০১৫ সালে বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
- ২০১৮ সালে বইটি ইংরেজি ভাষা থেকে কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। অনুবাদ করেন অধ্যাপক সিং হি জন।
- ২০২০ সালে নভেম্বর মাসে শাহীন আখতার তালাশ উপন্যাসের জন্য এশিয়া লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত এশিয়া লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
‘তালাশ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট, সমালোচনা ও তাত্ত্বিক ভাবনা
দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সংঘটিত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষের সম্মিলিত ঐক্যের দৃঢ় শপথে দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আমাদের ইতিহাসের এক বিস্ময়। ইতিহাস সৃষ্টির এই ক্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে বাঙালি নারী তাঁর দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু সেই গৌরবের চর্চিত ইতিহাসে নারী থেকেছে উপেক্ষায় এবং এখনো অপেক্ষায়। স্বাধীনতার ইতিহাসে নারীর অবস্থান যেন অনেকটা ‘‘না বললেই নয়’’ অবস্থা। একটি অগণনীয় সংখ্যার আঁধারে ঢেকে দেয়া হয়েছে তাদের সমস্ত ত্যাগ আর বীরত্বকে।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী, চলাকালীন এবং পরবর্তী সময় মিলিয়ে সবকিছুর এমন চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সেই ব্রিটিশদের মতো করেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে, সে বর্ণনা এসেছে এভাবে-
পাকিস্তান যেন দেশ নয়, গাভি একটা। তার সামনের দুই পা পূর্বে, পেছনের দুই পা পশ্চিমে। বাঙালিরা রোজ একে ঘাস খাওয়ায়, আর দুধ দুইয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শতকরা ৬০ ভাগ রাজস্ব আয় করে পূর্ব পাকিস্তান, খরচ করতে পারে মাত্র ২৫ ভাগ। বাকিটা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম।
পরিবার ও সমাজবিচ্ছন্ন হয়ে তারা ছিটকে পড়েছে অন্ধকার গুহায়। এসব নারীর জীবন না-জীবন হয়ে যাওয়ার দায় আমদের সমাজ ও রাষ্ট্রের। তালাশের কেন্দ্রীয় চরিত্র মরিয়ম। সে কেবল খড়কুটোর মতো ভেসেছে, কোথাও ঠাঁই পায়নি। বার বার উঠে দাঁড়াতে চেয়ে প্রবঞ্চিত হয়েছে স্বাধীন দেশে। তাই যুদ্ধকাল আর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের মধ্যে মরিয়মরা কোনো পার্থক্য খুঁজে পায়নি। তবে যুদ্ধের ভয়াবহতায় নিমজ্জিত থেকেও চোখে স্বপ্ন ছিল, কিন্তু স্বাধীন দেশে কেবল স্বপ্নভঙ্গই হয়েছে তাদের। যা আরো বেশি অভিমানের-অভিযোগের।
পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিপীড়িত ও সম্ভ্রম হারানো মরিয়ম স্বাধীন দেশেও শরীরকে নিরাপদ রাখতে পারেনি। বরং বার বার তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। স্বাভাবিক বাঁচার আকুতি তাকে আপসের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে। কিন্তু স্বস্তির দেখা সে কোনোদিনই পায়নি। ঔপন্যাসিক যার বর্ণনা এভাবেই করেছেন:
মরিয়ম হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর নিজের হয়নি।
মরিয়ম শিক্ষিত এবং সে অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। তাই ব্যক্তিত্ববোধে উচ্চকিত মরিয়ম বার বার নিজের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। কারো গলগ্রহ বা অনুগ্রহের পাত্রী হয়ে থাকার এই অনিচ্ছা তার নিয়তিকে নিয়ত উপহাস করেছে। শরীর বেচে বেঁচে থাকার সহজ পথ সে বেছে নেয়নি, বরং বাঙালি নারীর স্বামী-সংসারের স্বাভাবিক জীবনাকাঙ্ক্ষা তাকে বার বার তাড়িত করেছে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটতে পদে পদে তার কপালে জুটেছে গঞ্জনা আর বঞ্চনা।
মরিয়মের মত সাহসী নারীও অসহায়ের মত ধর্না দিয়েছে এর ওর কাছে। আর যারা তা পারেনি তাদের জায়গা হয়েছে জীবনের সরু পথে কিংবা বেশ্যালয়ে। যেন তারা আজীবনের জন্য নিপতিত হয়েছে নিষিদ্ধ পল্লিতে। অনুরাধা সরকার তাদেরই একজন। বিএম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী অনুরাধাকে পাকসেনারা পড়ার জগৎ থেকে তুলে এনে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে, যেখানে মরিয়মসহ আরো অনেকেই বন্দি ছিল। নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়াবহতায় থেকেও সে আনা ফ্রাঙ্কার মত যুদ্ধদিনের ডায়েরি লেখার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে সে তার সেই স্বপ্ন পূরণের পথ পায়নি। উপরন্তু তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল নিষিদ্ধ পল্লিতে। অসম্ভব বাস্তববাদী ও সম্মুখদ্রষ্টা অনুরাধা নিপীড়নের সেলে বন্দি থেকে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় সঙ্গীদের সতর্ক করেছিল। যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে তাদের সামগ্রিক মুক্তি মিলবে, এই ভাবনায় আচ্ছন্ন মরিয়মদের ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অসহায়ত্বের কথা সে এভাবেই ব্যক্ত করেছিল:
অনুরাধা বলে, তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধে নির্যাতিত পুরুষেরা পেয়েছে বীরের আসন, আর নারীরা হয়েছে কলঙ্কিনী। দেশ স্বাধীন হবার পরও যে তাদের বরণ করে নেওয়া হবে না, তা বেশ ভালোভাবেই জানতেন নির্যাতিত নারীরা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এই করুণ সত্যেরই চিত্র দেখা যায়। স্বাধীন দেশ পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে বীরত্বের মর্যাদা আর বীরাঙ্গনাকে দিয়েছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা। যুদ্ধে পরোক্ষ সহযোগিতা করা এবং প্রত্যক্ষ নির্যাতন-নির্মমতার শিকার হওয়া ছাড়াও পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ সমরে লড়াই করেছে অনেক বাঙালি নারী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তাদের অনেকেরই জোটেনি। যাদের স্বীকৃতি মিলেছে তাদেরও পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। মুক্তিযোদ্ধা পারুল একবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় আরেকবার বাদ পড়ে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও পরিবর্তন হয়। রাজনীতির এই হীনচক্রে নারী-পুরুষ সবাই সমানভাবে বলি হয়।
‘তালাশ’ উপন্যাসে শাহীন আখতার তুলে ধরেছেন তিনটি ভিন্ন সময়ের গল্প।
ক. যুদ্ধের আগে,
খ. যুদ্ধ চলাকালীন ক্যাম্প জীবন এবং
গ. পরবর্তী সময়ে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি পেয়েও একজন নারী এই সমাজে কীভাবে টিকে ছিলেন।
বীরাঙ্গনাদের হাহাকার:
১. বীরাঙ্গনা বলে আশ্রয় দেয় না;
২. বীরাঙ্গনা বলে বাড়ি ভাড়া দেয় না;
৩. বীরাঙ্গনা বলে চাকরি মেলে না;
৪. বীরাঙ্গনা বলে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটে না;
৫. যেখানে নিজের মা-বাবা, পরিবারই বীরাঙ্গনাকে মেনে নিতে পারেনি, সেখানে সমাজ আর রাষ্ট্র তো অনেক দূরের কথা;
৬. আর সেই বীরাঙ্গনা বলেই বাঁচার অধিকার নেই এই তথাকথিত সভ্য সমাজে।
এক বীরাঙ্গনা নারীর জীবনের সূত্র ধরে লেখিকা তুলে এনেছেন পুরো সময়টাকে। কীভাবে আসল মুক্তিযোদ্ধা অবহেলায় দিনাতিপাত করেছেন, যেখানে কোনো রাজাকার অবলীলায় মুক্তিযোদ্ধার তকমা পেয়ে গেছেন; কীভাবে বীরাঙ্গনা হিসেবে পুনর্বাসিত হওয়া সত্ত্বেও একজন নারী অসম্মানের পেশা বা নিজ পরিচয় গোপন করে সংসার করেছেন বা হয়তো মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন। কীভাবে সমাজ একজন বীরাঙ্গনাকে পদে পদে লাঞ্ছনা ও অত্যাচার করেছে, সে গল্প অবলীলায় বলে গেছেন লেখিকা।
যুদ্ধোত্তর সময়ে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে যেতে কীভাবে হামলে পড়েছিল বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো, সেসবের কথা প্রচার করতে মোটেও দ্বিধান্বিত হননি তিনি। এমনকি তিনি তুলে ধরেন এমন প্রসঙ্গও, যেখানে বর্ণিত হয় আসল যুদ্ধ তো ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়েছে; মুক্তিযোদ্ধারা কেবল পাশে থেকে সাহায্য করেছে। ইতিহাসকে বিকৃত করার লক্ষ্যে নয়; বরং বিকৃত মস্তিষ্ক কীভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করেছিল, তা-ই যেন তিনি স্পষ্টভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যেখানে নিজের মা-বাবা, পরিবারই বীরাঙ্গনাকে মেনে নিতে পারেনি, সেখানে সমাজ আর রাষ্ট্র তো অনেক দূরের কথা। সেখানে বীরাঙ্গনাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতির পিতা। পরবর্তীতে তার মৃত্যুতে পরিস্থিতি কীভাবে বদলে যায়, তার বর্ণনা এসেছে এভাবে-
বঙ্গবন্ধু চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোও উঠে গেল। শুনেছি জিনিসপত্রও নাকি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। পতিতালয় উচ্ছেদ করার মতো করে মেয়েদের তাড়িয়ে দেয়।
যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই কী করে বাঙালি সংস্কৃতি বদলে গিয়েছিল, তাও স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন লেখিকা। ধর্মের দোহাই দিয়ে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কী করে এক নিমেষে ধুলিসাৎ হয়েছিল, তার বর্ণনা রয়েছে এ বইয়ে; যেখানে এক অসাম্প্রদায়িক যুদ্ধের ফসল ছিল স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক থেকে সমাজতান্ত্রিক এবং সেখান থেকে স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কী করে প্রতিষ্ঠা পেল এ সমাজে, তার বিবরণও রয়েছে এতে। বিয়ের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসন দেয়ার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। কিন্তু সেই বিয়ে যে পাকিস্তানি সেনাদের দেওয়া বিভীষিকার এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল, সেটাও লিখতে ভুলেননি লেখিকা। বিষয়টি তিনি এভাবে বলেন,
ভালোবাসাহীন শরীরী সম্পর্ক একপ্রকার ধর্ষণই, পুরুষটি স্বামী হলেও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ভালোবাসার অর্থ কী। সংগম এবং ধর্ষণের ফারাক কী?
‘তালাশ’ উপন্যাসে শাহীন আখতার মূলত মরিয়ম নামে এক যুবতীর গল্প বলেছেন। যুদ্ধের আগে যার সম্পর্ক হয় এক তরুণের সঙ্গে। যে রাজনীতি করার স্বপ্নে বিভোর; যে উত্তাল সময়টাতে নিজের গা ভাসিয়ে দিতে ব্যস্ত; যে দেশটাকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে মত্ত। কিন্তু মরিয়মের পেটে অনাগত সন্তানের জনক হবার সময় নেই তার; এমনকি নেই সংসার বাঁধার সময়। তাই অনাহূত সন্তান বিসর্জন দেয় মরিয়ম। আর সেই দুঃখ ভোলার আগেই ঢাকার বুকে রাতের আঁধারে নেমে আসে শত শত বুট।
সেই বুটের আওয়াজ তাড়া করে ফিরে মরিয়মকে। চার দেয়ালে বন্দি হয়ে নয়টা মাস কাটিয়ে দেয় সে। যুদ্ধ শেষ হয়; সবকিছু নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু নতুন জীবন ফিরে পায় না কেবল মরিয়ম। চার দেয়ালের বন্দি জীবনের ট্রমা বাস্তবে রূপ নেয়। ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি মরিয়মকে খুব বেশীদিন সম্মানের আসনে বসিয়ে রাখতে পারে না। বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্র উচ্ছেদ হয়। বীরাঙ্গনা সম্মানে বিবাহিত জীবন ভেঙে যায়। সাধারণ নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকাটাই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায় মরিয়মের জন্য।
তিন দশক পর সেই গল্পই খুঁজে ফেরেন মুক্তি। আর সেই গল্পের অলিগলিতে মরিয়মের সঙ্গে তার জীবনের অর্থ খুঁজে ফেরে পাঠক।
পাকিস্তানি সৈনিক শওকতকে বিশ্বাস করে শ্যামলী নামের আরেক বীরাঙ্গনা প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। ‘‘শওকতকে বিশ্বাস করে শ্যামলী নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’’ বলে মরিয়ম কটাক্ষ করলে অনুরাধা আক্ষেপ করে বলে:
কোন দেশ? যে দেশ তোমার ওপর শ্ত্রুর নির্যাতনকে নির্যাতন বলে দেখবে না, দেখবে বেইজ্জতি হিসেবে, তারপর হয় আমাদের লুকিয়ে না-হয় বেশ্যালয়ের দিকে ঠেলে দেবে — সেই দেশের প্রতি?
বাস্তবে তা-ই হয়েছিল। প্রত্যেকেই পরবর্তী বাস্তবতা দিয়ে এই নিষ্ঠুর সত্যকে উপলব্ধি করেছিল। অন্ধকার জগতে নিজের পরিচয়কে আড়াল করতে বীরাঙ্গনা অনুরাধা নিজের নাম পরিবর্তন করে হয়েছিল রাধারাণী। এরকম নাম পরিবর্তন অনেককেই করতে হয়েছিল। বিন্দুবালা তাদের একজন। শুধু নাম নয়, লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার তাগিদে তাকে ধর্মও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বলা যায়, পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল সে। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে সে মুসলমান হয়ে লাইলি বেগম নাম ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধা নজর আলীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছিল। সীমাহীন অপমান-অপদস্ত থেকে হয়তো আপাত মুক্তি মেলে তার, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব বন্দি হয়ে পড়ে আজীবনের জন্য।
তালাশ উপন্যাসটি যুদ্ধের প্রায় ত্রিশ বছর পরে লেখা। মুক্তি নামক এক এনজিওকর্মী কর্তৃক বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্যদিয়ে এখানে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধকালীন ও স্বাধীন-পরবর্তী প্রায় তিন দশকের তাদের নিদারুণ জীবনবাস্তবতা। যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি উঠে এসেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজনীতি-রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ, যেখানে বীরাঙ্গনাদের কোনো অবস্থান নেই। তারা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
কতিপয় প্রতিনিধি চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক বীরাঙ্গনাদের বাস্তব চিত্রটি চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। যাদের কেন্দ্রভাগে আছে মরিয়ম। অনুরাধা, বিন্দুবালা, শোভা রানী, জবা, টুকি, শ্যামলী, বেবি, পারুল, এরা প্রত্যেকেই যুদ্ধের ভয়ায়বহতার শিকার। পাকিস্তানি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের সাক্ষী এদের অনেকেই। শরীর-মনে বহমান যুদ্ধের ক্ষত ও ক্ষতিকে তারা পুষিয়ে উঠতে পারেনি, বরং তাদের জীবনে নতুন নতুন ক্ষত যুক্ত হয়েছে। আর সেই ক্ষত তৈরি হয়েছে নিজ দেশের মানুষ ও সমাজ দ্বারা।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি নারীর জন্য আত্মহত্যাটাই যেন সবার স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। তাই বেঁচে ফিরে আসা মরিয়মকে আত্মহত্যা না-করার কৈফিয়ত দিতে হয়। মুক্তির এ সংক্রান্ত কটাক্ষের জবাবে মরিয়ম যখন বলে, ‘‘অহ! আমি কিন্তু আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। বাঁচার কথা ভাবতাম। আত্মহত্যার করার কথা ভেবেছি যুদ্ধের পর’’, তখন প্রশ্ন জাগে — এর জন্য দায়ী কারা? এই প্রশ্নের জবাবও ঔপন্যাসিক খুঁজেছেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, কেউই এই দায় থেকে মুক্ত নয়। যে পারুল যুদ্ধের মাঠে পুরুষের সাথে সমানতালে লড়াই করেছে, সেই পারুল যুদ্ধের পরে পুরুষ সহযোদ্ধার হাতে হয়েছে নিগৃহীত। ‘‘এই যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি?’’, পারুল মুক্তির এই প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘‘না, তখন এরকম কিছু হয়টয়নি। ছেলেতে-মেয়েতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে যাচ্ছি। সমস্যা হইছে যুদ্ধের পর, যখন সহযোদ্ধা শরাফত মিথ্যা কথা বুইলে পতিতালয় বিক্কিরি করতি নিয়া গেল আমারে।’’
তালাশ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস হলেও এখানে যুদ্ধ সময়ের ভয়াবহতার চেয়েও বেশি উঠে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার চিত্র, যেখানে ঔপন্যাসিকের মূল মনোযোগটি মূলত বীরাঙ্গনা ও বারাঙ্গনাদের প্রতি নিবদ্ধ থেকেছে। বাঙালি নারীর প্রতি সমাজের যে প্রবহমান অবজ্ঞা চালু ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশেও তা কমেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা বেড়েছে। যুদ্ধে অঙ্কিত অহংকারের চিহ্ন বহন করা নারীর জন্য তা ছিল আরো নির্মম। দৃষ্টির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই মানবেতর জীবনের গল্পগুলো ঔপন্যাসিক নিষ্ঠার সাথে উপস্থাপন করেছেন। সেই সাথে তাঁর অভিমান-অভিযোগ আর ক্ষোভের অঙুলি নির্দেশ করেছেন রাষ্ট্রের সচেতন অবহেলার প্রতি। ‘‘দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’’র যে ভাষ্য আমরা শুনি, তা নিমিষেই উপহাসে পরিণত হয় যখন এদের অনেকেরই নাম-পরিচয় ও তালিকা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু বীরাঙ্গনা পরিচয়টিই হয়ে ওঠে ভারবাহী। এটি যেন অপমানের সূত্র হয়ে ওঠে। তাই যন্ত্রণার যত্নে এই পরিচয়টি লুকাতে হয়েছে অনেককেই। সবার শ্যেন দৃষ্টির বাণে জর্জরিত মরিয়ম আক্ষেপ করে বলে — বীরাঙ্গনা উপাধিটা যেন বিষাক্ত পোকা কিংবা ছোঁয়াচে রোগ, মরিয়ম ভয়ানক তিক্ততা নিয়ে বলে, এর ছোঁয়া লাগলে শরীরে ঘা হবে, হাত-পা পচেগলে খসে পড়বে। অথচ তারাই শতমুখে বলত, ‘‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা জাতির গর্ব, তোমরা মহীয়সী নারী!’’
মরিয়মের এই গ্লানিমাখা ক্ষোভের জবাব আমাদের কাছে নেই। এ লজ্জা আমাদেরই! দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘‘গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলে পুলসেরাতও পার হওয়া যায়’’ উক্তিটি অতিরঞ্জন হলেও অযৌক্তিক নয়। অথচ সেই বাস্তবতায়ই একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা একজন বারাঙ্গনা তার সামাজিক মর্যাদাটুকুও পায় না। ঔপন্যাসিক এই অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
‘তালাশ’ উপন্যাসে নারীবাদ
নারীবাদ বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভুত একটি আন্দোলন যা নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটদানের অধিকার এবং নারী পুরুষ সমান এই দাবী থেকে শুরু হয়। ফরাসি ‘Femme’ শব্দ থেকে Feminism শব্দটি এসেছে, বাংলা অর্থ নারী। নারীবাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই কিন্তু নারী। নারীবাদের উৎপত্তি ঘটেছিল পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মধ্যে। মূলত পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মধ্যে নারীবাদের মূল প্রেরণা প্রোথিত। এসব তত্ত্ব থেকেই ধীরে ধীরে নারীবাদী আন্দোলন ও তত্ত্ব বিকশিত হয়েছে।
নারীমুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ রয়েছে। ‘তালাশ’ উপন্যাসে উদারতাবাদী/উদারপন্থী নারীবাদ (Liberal Feminism), সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism), মার্ক্সসীয় নারীবাদ (Marxist Feminism), অস্তিত্ববাদী নারীবাদ (Existential Feminism) তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
উদারতাবাদী/উদারপন্থী নারীবাদ (Liberal Feminism): লিবারেল নারীবাদ নারী স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ নারীবাদ পুরুষ অধিকারের পাশাপাশি নারী অধিকারের ওপর সমান মূল্য আরোপ করে। এ মতবাদের উদ্ভব ঘটে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ‘ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব ওম্যান’-এ (১৭৯২), এবং পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অব উইমেন’-এ (১৯৬৯)। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা মনে করেন যে, পরাধীন সত্তার মুক্তির আন্দোলন হলো লিবারেল নারীবাদ।”
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism): সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ হল একটি দ্বি-মুখী তত্ব যা নারীর নিপীড়নে পুঁজিবাদের ভূমিকার জন্য মার্কসবাদী নারীবাদের যুক্তি এবং লিঙ্গ ও পুরুষতন্ত্রের ভূমিকার উগ্র নারীবাদের তত্বকে বিস্তত করে। কয়েকজন প্রধান সমাজতান্ত্রিক তাত্তিক হলেন: জুলিয়েট মিশেল, আইরিশ ইয়ং।
মার্ক্সসীয় নারীবাদ (Marxist Feminism): ১৯শ শতকের শেষার্ধে মার্ক্সবাদী মতবাদকে কেন্দ্র করে যে নারীবাদী মতবাদ গড়ে ওঠে তা মার্ক্সীয় নারীবাদ নামে পরিচিত। মার্কসীয়দের মতে নারী ও শ্রমিকের স্বার্থ একই, কেননা নারী ও শ্রমিক একই রকমে শোষিত, মার্কসীয় নারীবাদের উদ্ভব ঘটে এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) সন্দর্ভে। মার্কসীয়রা বলেন যে, নারীশোষণ পুঁজিবাদের সৃষ্টি; তবে তাদের মতে পুঁজিবাদ নারীশোষণ বহুগুণে বাড়িয়েছে, এবং নারীকে অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে।
অস্তিত্ববাদী নারীবাদ (Existential Feminism): বিংশ শতাব্দীর সর্বগ্রাসী জীবনব্যবস্থার ব্যক্তির পরিচয় নিরুপনে ব্যক্তিবাদী মতবাদ হিসেবে অস্তিত্ববাদ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, অস্থিত্ব ও স্বাতন্ত্যের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই অস্তিত্ববাদী নারীবাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। সেখানে নারীর তার নিজ সত্তাকে বিকশিত করবে এবং সেখানে নারী পুরুষের মাঝে সাম্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন।
রেফারেন্স:
১. শাহীন আখতার : ‘তালাশ’
২. https://roar.media/bangla/main/book-movie/talash-a-novel-by-shahin-akhter
৩. https://shahojia.com/2020/12/15/শাহীন-আখতারের-তালাশ