Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

মেঘনাদবধ কাব্য তৃতীয় সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য: তৃতীয় সর্গের নাম সমাগম। প্রমােদ উদ্যান থেকে মেঘনাথপত্নী প্রমীলার লঙ্কায় প্রত্যাবর্তন এই সর্গের বিতয়। প্রমোদ কানন থেকে লঙ্কার পথে যাত্রা করার সময় মেঘনাদ তার পত্নী প্রমীলাকে বলে এসেছিলেন রাম- লক্ষণকে অচিরেই বধ করে তিনি সেখানে ফিরে যাবেন । কিন্তু অপরাহ্ন শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলল রাত্রির দিকে । তবু মেঘনাদ ফিরলেন না । এই দেখে প্রমিলা অস্থির হয়ে উঠলেন। এখনই আসবো বলে তিনি চলে গেলেন তাঁর এত বিলম্ব হচ্ছে কেন ? সান্তনা দেবার জন্য সখি বাসন্তী বললেন মেঘনাদের জন্য তিনি বৃথায় দুর্ভাবনা করছেন ; কারণ তাকে নিধন করতে পারে এমন বীর ত্রিভুবনে কোথাও নেই । তিনি শত্রুকে নিধন করে ফিরে আসবেন । এখন ফুল বনে গিয়ে ফুলের মালা গেঁথে সময়টা কাটিয়ে দিলে তার পক্ষে ভালোই হবে । মেঘনাদ ফিরে এলে সেই ফুলের মালা দিয়ে তিনি তার অভ্যর্থনা করবেন।
বাসন্তীর কথা শুনে প্রমিলা তাকে সঙ্গে করে ফুলবনে নিয়ে গেলেন । অনেক ফুল ফুটেছিল সেখানে । ম্লানমুখী সূর্যমুখীর কাছে গিয়ে সহানুভূতি স্বরে নিজের দুঃখের কথা তাকে জানালেন  ।  তারপরে অনেক ফুল তুললেন দুজনে ।  কিন্তু সবই বৃথা যায় তখনও ফিরলেন না  । হতাশায় ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেই রাত্রিতে লঙ্কায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি  ।  বাসন্তী ওই প্রস্তাবে বিস্মিত হয়ে বললেন যে সম্ভব নয় । লঙ্কার চারপাশে ঘিরে রয়েছে রাঘবের সেনানী ।  লক্ষ লক্ষ শত্রু অস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । তাদের মধ্য দিয়ে লঙ্কায় প্রবেশ করা কেবল দুঃসাধ্য নয় অসাধ্য। এই শুনে প্রমিলা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন । তাঁর বক্তব্য হচ্ছে পর্বত ছেড়ে নদী যখন প্রবল বেগে সাগর অভিমুখে ধাবিত হয় তখন তার গতিরোধ করতে কেউ পারে না । তিনি সহজ নারী নন ; দানব-নন্দিনী তিনি , আর রক্ষ: কুল বধু । তার শশুর রাবণ, স্বামী মেঘনাদ; ভিখারি রাঘব কে তিনি ডরান না । লঙ্কায় তিনি যাবেনই । কেমন ভাবে তাঁকে বাধা দেন তা তিনি দেখবেন ।
তার নির্দেশে চারপাশে সাজ সাজ রব পড়ে গেল । তার নারীবাহিনী সজ্জিতা হল অস্ত্রশয্যায় । চারপাশে কেঁপে উঠল ধনুকটঙ্কারে । কটিদেশে তাদের অসি ; হাতে ধনুক শুল ;  একশ চেড়ি প্রমীলার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হল  ।প্রমিলা নিজেও রণরঙ্গিনী বেশভূষা করলেন । কবরীর উপরে তাঁর শোভা পেল কিরিটির ছটা ; অঞ্জনের রেখা ভালে ; উচ্চ দুটি কবচে আবৃত ; কটিদেশ স্বর্ণ-সারাশান । হৈমময় কোষে খরসান অসি ; করে দীর্ঘ শুল। লঙ্কাযাত্রার প্রস্তুতি পর্ব  তাঁর সমাপ্ত । তারপর সখি সৈনিকদের সম্বোধন করে তিনি বললেন:  অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ লঙ্কা থেকে ফিরে আসতে কেন এত বিলম্ব করছেন তা আমি জানি না । আমি আজ রামচন্দ্রের কটককে বাহুবলে পরাজিত করে লঙ্কাপুরে প্রবেশ করব । আমার কপালে যা থাকে থাক । এইভাবে বীরাঙ্গণা সখীদের নিয়ে প্রমিলা বীরদর্পে লঙ্কার অভিমুখে যাত্রা করলেন । কনক লঙ্কা টলে উঠল, গর্জে উঠলো জলধি  ।  অশ্বক্ষুরের ধূলিতে অবরিত হলো চারিদিকে । কিন্তু তাতে বামাদের উজ্জ্বল দেহ-কান্তি ঢাকা পড়লো না ।
কিন্তু লঙ্কায় প্রবেশ করার পথে প্রথম বাধা এল পবন নন্দন ভীষণ দর্শন হনুর কাছ থেকে । তার ধারণা হয়েছিল রাক্ষসেরা মায়া বলে সুন্দরী রমণীদের বেশ ধরে রাঘব সেনানীদের ক্ষতি করার জন্য সেখানে এসে হাজির হয়েছে । এই মনে করে সে গর্জন করে সামনে এগিয়ে গেল । প্রমীলার সখি নুমুন্ডমালিনী কদণ্ডের টংকার দিয়ে  বীর দর্পে হুংকার ছেড়ে বলল: তার মতো ক্ষুদ্র জীব কে সে হত্যা করতে চায় না । তার চেয়ে সে যেন সীতানাথ কে ডেকে আনে সেই সঙ্গে ঠাকুর লক্ষণ আর রাক্ষস কুল কলঙ্ক বিভীষণকে । আরো সে জানালো যে অরিন্দম ইন্দ্রজিতের পত্নী প্রমিলা সুন্দরী প্রতিপদ পূজার জন্য বাহুবলে লঙ্কায় প্রবেশ করবেন । এই শুনে বীর হনুমান একটুকু এগিয়ে গিয়ে সভয়ে চেয়ে দেখল বীরাঙ্গনাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রমিলা । লঙ্কায় অনেক সুন্দরী রমণীদের সে দেখেছে , কিন্তু এত রূপবতী তার চোখে পড়েনি । তাই সে বিনীতভাবে প্রমীলাকে সম্বোধন করে জানালো যে রঘুকুলরবি রামচন্দ্র লক্ষ লক্ষ বীরদের নিয়ে সেতুবন্ধন করে লঙ্কায় এসেছেন । তার অরি রক্ষ:রাজ  । কিন্তু অবলাদের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই । রঘুনাথ দয়ার সিন্ধু । তার কাছে প্রমীলার কোন অনুরোধ থাকলে বা কেন তিনি এসেছেন তা জানাতে পারলে রঘুনাথ কে সে জানাবে । প্রমিলা তখন  মুণ্ডমালিনী কে হনুমানের সঙ্গে দিয়ে বললেন তার বক্তব্য রঘুনাথকে জানাবে ।
প্রভু রামচন্দ্র,  লক্ষণ,  বিভীষণ এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে বসে বসে মায়াদেবীর প্রেরিত অসির প্রশংসা করেছিলেন । এমন সময় ভৈরবরুপিনি  মুন্ডমালিনী সেখানে উপস্থিত হয়ে গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে প্রমীলার বার্তা তাকে দান করে বলল,  হয় তাকে লঙ্কাপুরে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে দিতে হবে নচেৎ তার সঙ্গে করতে হবে অসি-যুদ্ধ। এই শুনে রঘুপতি বললেন কারো সঙ্গে তিনি অকারণে বিবাদ করেন না তাছাড়া তার একমাত্র শত্রু রাক্ষসরাজ রাবণ । প্রমীলার সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই । প্রমিলা সচ্ছন্দে লঙ্কাপুরে প্রবেশ করতে পারেন । এর পরে তাঁকে আশীর্বাদ করে তাঁদের পথ ছেড়ে দিতে এবং বামাদের প্রতি শিষ্টাচার দেখাতে হনুমানের প্রতি নির্দেশ দিলেন তিনি । রামচন্দ্রের নির্দেশে হনুমান নুমুন্ডুমালিনীকে নিয়ে প্রস্থান করল । তার পরে বামাদল নিয়ে প্রমিলা সুন্দরী দশদিক উজ্জ্বল করে লঙ্কাপুরীর দিকে প্রস্থান করলো । সেই অপরূপ নারীবাহিনী কে দেখার জন্য সকলের সঙ্গে রামচন্দ্র শিবিরের বাইরে বেরিয়ে এলেন । দেখলেন কৃষ্ণ অশ্বে অরুরা হয়ে নুমুন্ডুমালিনী চলেছেন সকলের আগে তার পেছনে বাদ্যকারী বিদ্যাধরী দল পেছনে শুলধারীদের মাঝখানে স্বয়ং প্রমিলা ।
প্রমীলা কে দেখে রামচন্দ্র বিভীষণকে বললেন এমন রমণী তিনি ত্রিভুবনে কোথাও দেখেননি । সত্যিই কি প্রমিলা কোন রমনী, অথবা মায়াবিনি কোন রাক্ষসী ? বিভীষণ বললেন কালনেমি নামে বিখ্যাত দৈত্যের কন্যা প্রমিলা ;  মহাশক্তি  বংশে তার জন্ম । বীর্যবতী রমণী । কালহস্তীসম মেঘনাদ তার প্রেমের নিগড়ে বাঁধা পড়েছেন । রামচন্দ্র মেঘনাদের প্রশংসা করে চিন্তিত হলেন কারন একা মেঘনাদকেই এটে ওঠা ভার ম তার ওপরে তার সঙ্গে যোগ দিলেন দানবীর প্রমিলা । এখন বিভীষণই তার একমাত্র ভরসা । সৌমিত্রি  কেশরী লক্ষণ বললেন দেবতারা তার সহায় । সুতরাং মেঘনাদকে আর তিনি ডরায় না । পিতা রাবণের পাপে পুত্র মেঘনাদের পতন অনিবার্য । বিভীষণ লক্ষণের মন্তব্যে সায় দিয়ে বললেন যথা ধর্ম তথা জয় । রাবণ পাপী তাই তার ধ্বংস অনিবার্য । এদিকে প্রমিলা সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে লঙ্কার কনকদ্বারে উপস্থিত হলেন । সেই রাত্রিতে তাদের দেখে শত্রু মনে করে রাক্ষসদ্বারিরা চারপাশে শিঙ্গা , দুন্দ্ভি  বাজিয়ে ঘর রবে গর্জন করে বাঁধা দিলো তাদের । কিন্তু তারপর তাদের সত্যিকারের পরিচয় পেয়ে আনন্দে উন্মুক্ত করল ফটক।  আনন্দে কনক লঙ্কা প্রমীলার জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়লো । কুলবধুরা দিল উলুধ্বনি । প্রমিলা প্রবেশ করলেন পতির মন্দিরে । তারপরে স্বামীকে সম্ভাষণ করে মন্দিরে  প্রবেশ করলেন তিনি । বীরের ভূষণ পরিত্যাগ করে কুলবধুর পরিধান করলেন রেশমি শাড়ি । অলঙ্কারে ভূষিত হলেন তিনি তার পরে ফিরে এসে স্বামীর সঙ্গে তিনি বলেন স্বর্ণ সিংহাসনে । চারপাশে ভরে উঠলো আনন্দ সঙ্গীতে। তৃতীয় সর্গের নাম সমাগম।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.