বাংলা গদ্য ইতিহাসের প্রথম পর্বের প্রধান পুরুষ রামমােহন রায়। যে ভিত গড়ে উঠেছিলাে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মুনসিদের হাতে, হােক তা অনুবাদ, হােক পাঠ্যস্তরে উপযােগী প্রাথমিক খােঁজখবর, একটা ভাষা কাঠামাে তাদের হাতেই চেহারা পায়। আর এই ভিত্তির উপরে রাজা রামমােহন এবং বিদ্যাসাগরের তাবৎ কীর্তিস্তম্ভ গড়ে তােলা। রাজা রামমােহন (১৮১৫-১৮৩০), এই পনেরাে বছর ধরে আধুনিকতার পথ খনন করে গেছেন। বাঙালীর পরম সৌভাগ্য রামমােহন মতন এমন বিশাল, যুক্তিবাদী, বিদ্রোহী চরিত্রের ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিলাে আমাদের মধ্যে।
ডঃ সুকুমার সেন রামমােহন সম্পর্কে চমৎকার একটি উক্তি করেছেন— গীর্জা ও পাঠশালার বাহিরে আনিয়া, বিচার বিশ্লেষণে উচ্চতর চিন্তার বাহন হিসাবে প্রথম ব্যবহারে লাগাইয়া, বাঙ্গালা গদ্যকে জাতে তুলিলেন। আধুনিক কালের পুরাে ভূমিকায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও মনস্বী ব্যক্তি রামমােহন রায়। (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; ২য় খণ্ড)
রামমােহন এবং বিদ্যাসাগরকে জানা বাঙালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার অহংকারকে অনুভব করা। রাজা রামমােহন গল্প, উপন্যাস, সরস নিবন্ধের লেখক ছিলেন না, তিনি মূলত চিন্তাবিদ, কর্মী ও সংস্কারবাদী। শুধু বাঙলা নয়, ভারতের ইতিহাসের আধুনিক যুগেরও প্রবর্তক হলেন রামমােহন। ইংরেজী শাসন প্রবর্তন, ইংরেজী শিক্ষা প্রসার ও তার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষার, এবং যুক্তিবাদী ভাবনার আগমন কাল থেকেই আধুনিক বাংলা তথা ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতির উৎসব। ধর্মীয় সংস্কার চালিত, সাহিত্য, শিল্প মূলত গ্রাম্য জীবনাশ্রিত অনড় অবস্থার মধ্য থেকে তার আগে জন্ম নিতাে। গতানুগতিকতা যেমন ছিলাে মধ্য যুগের সাহিত্যে, তেমনি ছিলাে ধর্মীয় ভাব ও সংস্কারে প্রাধান্য। আমাদের দেশের সেই ভূতাকে ধাক্কা মারলাে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানসাহিত্য, আমরা নগর কেন্দ্রিক যুক্তি নির্ভর, কর্মব্যস্ত এক জীবনে প্রবেশ করে নতুন করে সব কিছুর মূল্যায়ন করতে শুরু করলাম। শুরু হলাে নতুন এক যুগের। আর এই যুগের ভাব ভাবনা ভাষা পেলাে গদ্যকে আশ্রয় করে যা আগে ছিলাে না। রামমােহনের হাত ধরে এই বাংলা গদ্যের জয়যাত্রার সূচনা হলাে।
১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমােহনের জন্ম। জাতিতে ব্রাক্ষ্মণ রামমােহনের পিতা ছিলেন জমিদার। মা ছিলেন নিষ্ঠাবতী হিন্দু রমণী। বাবা রামাকান্ত রায় ঘাের বিষয়ী ছিলেন। রামমােহনকেও তিনি বিষয় বুদ্ধিতে পারদর্শী করে তুলেছিলেন, আর সেকালের সরকারি ভাষা আরবি ফারসিতে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু মুলত, রামমােহন ছিলেন জ্ঞান ভিক্ষু। তাছাড়া সংবেদনশীল মানুষটি হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংসল্পর ও নানা প্রথার অমানবিকতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করে হয়ে পড়লেন কিছুটা হিন্দু-ঐতিহ্য বিরােধী। তার নাম যুক্ত হয়ে গেছে সে কালের নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার সঙ্গে। ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মের এক ঈশ্বর এই চেতনার উদ্বুদ্ধ হলেন রামমােহন। হিন্দুধর্মের মুর্তি পুজার বিরুদ্ধে বিরাগ জন্মালাে তার মনে। পরবর্তীকালে তার প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী ধর্ম, ব্রাক্ষ্ম ধর্ম এই নতুন চেতনার বাস্তব প্রয়ােগ বলা চলে।
তার কর্মক্ষেত্রে সেকালের কলকাতা শহর, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজধানী। তিনি যখন কলকাতায় এলেন তখনাে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। নিজে কিন্তু সংস্কৃত ও ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলেন।
বাংলা ভাষা, বিশেষ করে তার গদ্যচর্চার মূলে তার যুক্তিবাদী মন ও প্রতিবাদী চরিত্র। একদিকে নিজের হিন্দুধর্মের কুপ্রথার ও স্বজনদের অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কলম নিয়ে, অন্যদিকে বিদেশী-ধর্মর্যাজকদের অকারণ আক্রমণের বিরুদ্ধে যুক্তি-প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে, লেখাকে মাধ্যম করে নিলেন। নিজের জাতিকে তিনি ভালােবাসতেন যেমন, আবার তার অযৌক্তিক নিষ্ঠুর ক্রিয়াকাণ্ডকে আঘাত হানতে তার জুড়ি ছিলাে না। মূলত, এই দুটি কাজে ব্যাপৃত হয়ে বাংলা গদ্যকে যুক্তি ও মুক্তির উপায় রূপে ব্যবহার করলেন রামমােহন।
আজকের এই স্বার্থপরতার যুগে, ব্যক্তি লােভ ও নীচতার অজস্র উদাহরণের যুগে রামমােহনের কথা স্মরণ করা যেন মানবতার আদর্শকেই মনে করার সামিল। কেননা, এই প্রবল ব্যক্তিত্বের মানুষটির মধ্যে ছিল অসম্ভব মানব-প্রেম। মানুষকে ঈশ্বরের সন্তান ভেবেছেন তিনি, আর মানুষের সেবাকেই ভেবেছেন ঈশ্বর সেবা। সেকালের নারী সমাজের ছিল চরম দুরবস্থা। সতীদাহ এক নিষ্ঠুর প্রথা। যা রামমােহনকে ব্যথিত ও খুব চঞ্চল করে তুলেছিল। তিনি সেই দুঃখ নিবারণের জন্য কাজে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এবার যুক্তি দিয়ে প্রবন্ধ লিখে সতীদাহের সমর্থকদের ছিন্ন ভিন্ন করেছিলেন। স্বভাবতই যুক্তির ভাষা গদ্যকেই তিনি অস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। সে সময়ে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের গদ্যচর্চা তার অর্থ অনেক সময়েই বােঝা যেত না, সাধারণ মানুষ সে সম্বন্ধে তেমন জানতাে না, আবার তাদের কাজ মুলত ছিল পাঠ্য পুস্তক লেখায় সীমাবদ্ধ। রামমােহন সে কালের শিক্ষিত বাঙালী। পাঠকের মনে তার ভাবনাকে পৌঁছে দেবার জন্যে বাংলা গদ্যের নির্মাণে মন দিলেন। ফলে, তার একটি নিজস্ব সটাইল গড়ে উঠল। প্রকৃত পক্ষে বাংলা গদ্যের নতুন পথ তিনি আবিস্কার করেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তিনি গদ্যকে নিয়ে এলেন। সেকালের বিখ্যাত কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন যে, দেওয়ান জি (রামমােহন) জলের মত সহজ ভাষা লিখতেন, বিবাদ ঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাব সহজে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পেত আর তার ফলে পাঠকেরা তা সহজেই বুঝতে পারতেন। কিন্তু তাতে বিশেষ পারিপাট্য ও মিষ্টতা ছিল না।
গােপাল হালদার এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, রামমােহনের ভাষা ছিল কর্মী পুরুষের ভাষা, একজন বিচার দক্ষ তাত্ত্বিকের ভাষা। সে ভাষা ভাবুকের ভাষা নয়, শিল্প রসিকের ভাষা নয়। প্রাঞ্জল কি, সরস নয়।
তার বিরুদ্ধবাদী হিন্দু রক্ষণশীল সম্প্রদায় এবং খ্রীষ্টান পাদ্রীদের আক্রমণ ও যুক্তিকে খণ্ডন করে যুক্তি দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্যই তাকে যুক্তি মুখীন গদ্য গড়ে তুলতে হয়েছিল। এই সময়ে এসেছিলেন ডেভিড হেয়ার, ডিরােজিওর মত অসাধারণ শিক্ষাবিদ, মনের দরদী পুরুষ। এসেছিল হিন্দু কলেজের ইয়ং বেঙ্গল নামে বিদ্রোহী সম্প্রদায়। রামমােহনের সমর্থক রূপে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রভৃতি নব্যশিক্ষিত প্রধান ব্যক্তিগণ। পাঠ্য পুস্তুক রচনার জন্য গড়ে উঠেছে কুল বুক সােসাইটি। শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ছিলেন উইলিয়াম কেরী, রাধাকান্ত দেব এবার শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ। আবার এই সময়ে লেখকদের জন্যে সাময়িক পত্র বা সংবাদ পত্র নিল বিশেষ ভূমিকা। সে ইংরেজই হােক বা বাঙালিই হােক, খবরের কাগজে সংবাদ পরিবেশনের জন্য চাই গদ্যভাষা। একটির পর একটি সংবাদ পত্র বেরুতাে তখন। আর তাতে নিয়মিত লেখক শ্রেণী গড়ে উঠল। এবং এই সময়ে ভবাণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত দু-একজন লেখকের রস রচনা গদ্যে লেখার সূচনা হল। রামমােহনের কালে ধম নিয়ে পক্ষেবিপক্ষে প্রচার ও বিতর্ক মূলত গদ্যে আরাে তীব্র হল। রামমােহন ভারতের ঐতিহ্য দেখাবার জন্য উপনিষল অনুবাদ করলেন, দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র অনুবাদ করলেন।
তাঁর প্রধান প্রধান রচনা হল বেদান্ত (১৮১৫) বেদাসর (১৮১৫) ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গােস্বামীর সহিত বিচার(১৮১৮) সহমরণ, বিরােধী (১৮১৭), পুর্তিকা হল প্রবর্তক ও নিবর্তকের সন্ধাদ(১৮১৮)। পথপ্রদান (১৮২৩)। তাছাড়া শ্রীরামপুরের পাদ্রীরা যখন হিন্দু ধর্ম ও খ্রীষ্ট ধর্মের মধ্যে বিতর্ক চালাচ্ছিলেন তখন তিনি প্রকাশ করেন ‘ব্রাক্ষ্মণ-সেবধি’ (১৮২১) ও সম্বাদ কৌমুদি (১৮২১) নামে দুটি পত্রিকা।
তিনি ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত নিজস্ব একটি ভাষা গড়ে নিয়েছিলেন তা, উপনিষদের অনুবাদই হােক বা বেদান্ত গ্রন্থের ভাষায় হােক। তবে সহমরণ প্রথা নিবারণের জন্যে যে পুস্তিকা রচনা করেন তার ভাষা মুক্তি ও চিন্তায় সমৃদ্ধ। ১৮১৫—১৮৩৩ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি বাংলা ও সংস্কৃতে অনেকগুলি বই লিখেছিলেন। তাতে বেদান্ত উপনিষদ, সহমরণ বিষয়ে তার নির্ভিক যুক্তি উপস্থাপনা, পাদ্রীদের সঙ্গে যুক্তিতর্ক, একজন ব্রম্নধর্মী গৃহস্থের আচরণ বিধি, ব্রম্ন সীত এমন কি গােত্রীয় ব্যকরণ ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও ইংরেজী, সংস্কৃত, আরবী, ফরাসী ভাষায় লেখা অনেক রচনা তার ছিলাে। তারাই হাতে প্রথম ব্যক্তিত্ববান বাংলা গদ্যের জন্ম জয়। বিচার বিশ্লেষণ, যুক্তি সিধান্ত তার গদ্যকে খুব সচল ও জীবম্ভ রখেছে। এবার তারই যুগে শুরু হয়েছিল বাংলার রেনেসাঁ। তিনি তার অগ্রদূত।
রবীন্দ্রনাথ রামমােহন সম্বন্ধে লিখেছিলেন; ‘কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা কী সমাজ, কী ভাষা, আধুনিক বাদেশ এমন কিছুই নাই রামমােহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করেন নাই। রামমােহন রায় সম্বন্ধে এই উক্তি সব অর্থেই সত্য ভাষণ।
সহায়ক গ্রন্থ
১. বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা—গােপাল হালদার।
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ২—ডঃ সুকুমার সেন।
৩. সাহিত্য সাধক চরিতমালা—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
৪. ভারত কোষ ঃ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত।
৫. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত—ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. Bengali literature in the Nineteenth Century D. Sushil Kumar De.
৭. বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা ঃ ডঃ ভূদেব চৌধুরী।
৮. দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন—চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৯. প্রথম বাংলা সাময়িক ও সংবাদপত্র—অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।