বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য রচয়িতা মাইকেল মুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। তাঁর রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয়। বলা হয় এ কাব্য রচনার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। গঠন রীতির দিক নিয়ে এ মহাকাব্য বাংলা কাব্য ইতিহাসে অভিনব এবং অনন্য। শুধু ইতিহাসের দিক থেকে নয়, আখ্যানভাগের রসাস্বাদনের দিক থেকেও এর মূল্য অনেক। গঠন রীতির নৈপুণ্য এ কাব্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে। ‘মেঘনাধবধ কাব্য প্রকাশের পর একাধিক সমমালােচক নানা অভিমত প্রকাশ করেন। নিম্নে মেঘনাথবধ কাব্য সম্পর্কে সমসাময়িক সমালােচকদের অভিমত তুলে ধরা হলো:
রাজনারায়ন বসু
কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। এই কাব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি। কবি স্বয়ং যদিও রচনাকালে পান্ডুলিপি পাঠিয়ে মতামত ও পরামর্শ চেয়েছিলেন। রাজনারায়ন লিখেছেন, “জাতীয় ভাব বােধহয় মাইকেল মধুসূদনেতে | যেরূপ অল্প পরিলক্ষিত হয় অন্য কোন বাঙালী মন হয় না। তিনি তাঁহার কবিতাকে হিন্দু পরিচ্ছদ দিয়াছেন বটে কিন্তু সেই হিন্দু পরিচ্ছদের নিম্ন হইতে কোট প্যান্টালুন দেখা যায়।
আর্যকুলসূর্য রামচন্দ্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ না করিয়া রাক্ষসদিগের প্রতি অনুরাগ ও পক্ষপাত, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে হিন্দুজাতির শ্রদ্ধাস্পদ বীর লক্ষ্মণকে নিতান্তই কাপুরুষের ন্যায় আচরন করানাে, ঘর ও দূষনের মৃত্যু অবতারন রামচন্দ্রের হাতে হইলেও তাহাদিগকে এতপুরে স্থাপন, বিজাতীয় ভাবের অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে এই তিনটি এখানে উল্লিখিত হইতেছে।”
কালীপ্রসন্নসিংহ
এই কাব্যের যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন এবং তার বিদ্যোৎসাহীনী সভার পক্ষ থেকে কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার আয়ােজন করছিলেন। তিনি মেঘনাথবধ কাব্য সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যে একপ্রকার কাব্য ঢুদিত হইবে, বােধ হয় সরস্বতী ও জানিতেন না।….. লােকে অপার ক্লেশ করিয়া জলধি-জল গৃহমধ্যে প্রার্থনাধিক রত্নলাভে কতার্থ হইয়াছি। এক্ষনে আমরা মনে করিলে শিরোভূষনে ভূষিত করিতে পারি একপ্রকার কাব্য উদিত হইলে, বােধ হয় সরস্বতী জানিতেন না। …… লােকো অপার ক্লেশ করিয়া জলধি-জল হিতে রত্ন উদ্ধারপূর্বক বহু মুনি অলঙ্কার সন্নিবেশিত করে। আমরা বিনা ক্লেশে পুহমধ্যে প্রার্থনাধিক গলাভে কৃতার্থ হইয়াছি। এক্ষনে আমরা মনে করিলে তাহারে শিরােভূ মনে ভূষিত করিতে পারি এবং অনাদর প্রকাশ করিতে পারি এবং অনাদর প্রকাশ করিতে ও সমর্থহই।”
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৬৭ সালে প্রকাশিত মেঘনাথবধ কাব্য এর ট্রিীয় সংস্করনের ভূমিকায় হেমচন্দ্র লিখেছিলেন, এই গ্রন্থখানিতে অবার্তা যে অসামন্য কবিত্বশক্তির পরিচা | দিয়াছেন, তাদৈষ্টে বিষ্ময়াপন্ন ও চমৎকৃত হইতে হয় – সমস্ত বিবেচনা করিয়া দেখিলে বঙ্গভাষায় ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য ক্সার দেখিতে পাওয়া যায়না।……. সত্য বটে, কলি গুরু বালীকির পদচিহ্ন লক্ষ্য করিয়া নানা দেশীয় মহাকবিদের কাব্যোলান হইতে পুষ্পচয়নপূর্বক এই গ্রন্থখানি বিরচিত হইয়াছে,কিন্তু সেই সমস্ত কুসুমরাজিয়ে যে অপূর্ব মাল্য গ্রথিত হিয়াছে, তাহা বঙ্গবার্সী চিরকাল যত্ন সহকারে কণ্ঠে ধাৱন করিবেন।…… যে
হে স্বর্ণ, ম, পাতাল ত্রিভুবনের রমনীয় এই ভয়াবহ প্রানী ও পদার্থসমূহ একত্রিত করি পাঠকের দর্শনেন্দ্রিয় লক্ষন ঢিলফাকের ন্যায় দিলিত হইয়াছে, যেগন্থ পাঠ করিতে করিতে ভূতুকালে বর্তমান এবং অদৃশ্যে বিদ্যমানের ন্যায় জ্ঞান হয় – যে গ্রন্থ পাঠ করিতে করিতে কখন বা বিস্ময়, বান বা ক্রোশ এবং কমন বা করুনারসে আদ্র হইতে হয় এবং বাস্পীকুল
লােচনে যে গ্রন্থের পাঠ সমাপ্ত করিতে হয়, তাহা যে বঙ্গাসীরা চিরকাল বক্ষস্থলে ধারন করিবেন, ইহার বিচিত্ৰতাকি।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
‘মেঘনাথ বধ কাব্য’ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র গুরুত্বপূর্ন সমালােচনা করিয়াছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “The meghnadbadh is Mr Dutta’s great work. The sbject is taken from the Ramayana, the Source of inspiration to so many Indian poets. In the was with Ravana Meghnada, the most heroic of Ravan’s sons and warriors, is slain y Laksman, Ram’s brothedr. This is the subject and Mr. Dutta owes a great deal more to Valmiki than the mere story. But nevertheless the poem is his own work from beginning to end. The scenes, characters machinery and episodes are in many respects of Mr Duttga has displayed a high oder of art Tottomer and Miltonas well as to Valmiki, he is largely indebted in many ways, but he has assimilated and made his own most of the ideas which he has taken and his poem is on the whole the most valuable work in morden Bengali literature.
রবীন্দ্রনাথঠাকুর
মেঘনাথবধ কাব্য এর কবিকল্পনার অভিনবত্ব স্বীকার করে যা বলেছিলেন তা উদ্ধারযােগ্য – “ মেঘনাথবধ কাব্যে, কেবল ছন্দবন্ধে ও রচনা প্রনালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের একটা অপূর্বপরিবর্তন দেখিতে পাই। তিনি (মধুসুদন) স্বতস্ফূর্ত প্রচন্ড লীলার মধ্যে আন্দবােধ করিয়াছেন; ইহার রথ-রথি অশ্বে গজে পৃথিবী কম্পমান; যাহা। চায় তাহার জন্য এই শক্তি শাস্ত্রের বা অস্ত্রের কোন কিছুর বাধা মানিতে সম্মত নহে। … যে অটল শক্তি ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনমতেই হার মানিতে চাহিতেছে নাকবি সেই ধৰ্ম্মাবিদ্রোহী মহাদন্ডের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে, তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালামানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।”