‘আরণ্যক’ সম্পর্কে বিভূতিভূষণ ভূমিকার এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে উপন্যাস। অভিধানে লেখে ‘উপন্যাস’ মানে বানানো গল্প। অভিধানকার পণ্ডিতদের কথা আমরা মানিতে বাধ্য । তবে ‘আরণ্যক’- এর পটভূমি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয় । কুশী নদীর অপরপারে এমন দিগন্ত বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রস্তর পূর্ব্বে ছিল , এখনও আছে । দক্ষিণ ভাগলপুর ও গয়া জেলার বনপাহাড় তো বিখ্যাত। উপন্যাস মানে কেবল ‘ বানানো গল্প ‘ একথা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণযোগ্য নয় । উপন্যাসকে বলা হয় ‘ মানবজীবনের গদ্যময় রূপ ( prose of man’s life )। বাস্তবতার ভিত্তির ওপরই মানবজীবন – কাহিনি দাঁড়িয়ে থাকে , তবে ঔপন্যাসিক অবশ্যই বাস্তবের সঙ্গে কল্পনাকে মিলিয়ে দেন। ‘আরণ্যক’ – এর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে । যে অরণ্যপ্রাপ্তর – এর পটভূমি তা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্যচরণের দেখা প্রকৃতি ও মানুষ আসলে বিভূতিভূষণেরই দেখা । স্মৃতির রেখা’র মতো দিনলিপিতে বর্ণিত নানা ঘটনা , চরিত্র এবং লেখকের মন্তব্য অবিকল ‘ আরণ্যক ‘- এ ব্যবহৃত হয়েছে । তাই ‘ আরণ্যক ‘ বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
‘আরণ্যক’ – এর উপন্যাসলঞ্চণ বিচারের আগে এক ‘ ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘ বা ‘ ডায়েরি ‘ বলা চলে কিনা সে আলোচনা সেরে নেওয়া যেতে পারে । লেখকের বোধ হয় মনে হয়েছিল যে , সত্যচরণের জঙ্গলমহলে প্রবেশ ও প্রস্থান পাঠকের কাছে একজন ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতা বলে মনে হতে পারে । নিজের জিনিসপত্র নিয়ে একদিন সভাচরণের বি.এন.ডব্লিউ রেলওয়ের একটি ছোটো স্টেশনে নামা , নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা, তারপর একদিন বিদায়গ্রহণের মধ্যে যেন ভ্রমণকাহিনির স্বভাবধর্ম আছে । ভ্রমণকারীর মতোই যেন সত্যচরণ একের পর এক নানা ঘটনা ও চরিত্রকে নিরাসক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং বিশ্লেষণও করেছে । কোনোকিছুর সঙ্গেই স্থায়ী একাত্মবোধ স্থাপন করেনি। কিন্তু নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সত্যচরণ লবটুলিয়া – আজিমবাদ – ইসমাইলপুরে যায়নি , সে গিয়েছিল চাকরি নিয়ে । চাকরি একটা নির্দিষ্ট বন্ধন , যথার্থ ভ্রমণকারী কোনো নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতার শর্তে আবদ্ধ থাকে না । সে নিজের পছন্দমতো পরিভ্রমণ করে বেড়ায় । দীর্ঘকাল কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকলে ভ্রমণকারীর সচলতা নষ্ট হয়ে যায়।
‘আরণ্যক ‘ উপন্যাসের নায়ক সভ্যচরণ তার নিয়োগকর্তা জমিদারের প্রায় পঁচিশ হাজার বিঘে জঙ্গলমহালের প্রজাবিলির দায়িত্ব নিয়ে এসেছিল । দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত স্থানত্যাগের স্বাধীনতা তার ছিল না । তাই ভ্রমণবৃত্তাত্তের চলমানতা আলোচ্য গ্রন্থে নেই । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে লেখকের খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতার সম্মিলিত রূপ এই রচনা । এটা ভ্রমণকাহিনির লক্ষণ নয় । ‘ ডায়েরি ‘ কথাটিও ‘ আরণ্যক ‘ প্রসঙ্গে স্বয়ং লেখক ব্যবহার করেছেন । ডায়েরি বা দিনপঞ্জিতে প্রতিটি নির্দিষ্ট দিনে লেখকের অভিজ্ঞতা বা তাঁর মনোভাব বর্ণিত হয় । প্রত্যেকটি দিনের কাহিনিই আলাদা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ । কিন্তু ‘ আরণ্যক ‘ – এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি । আঠারোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই বৃহৎ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যচরণ । তাকে কেন্দ্র করেই সমস্ত ঘটনা আবর্তিত হয়েছে এবং কাহিনি পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে । সত্যচরণের দিনওয়ারি অভিজ্ঞতা এখানে নেই , থাকার কথাও নয় । তাই একে ‘ ডায়েরি ‘ হিসেবে চিহ্নিত করাও সম্ভব নয় । তবে ‘ আরণ্যক ‘ প্রসঙ্গে লেখকের মনে দিনপঞ্জির কথা মনে হওয়ার একটি কারণ থাকতে পারে । তাঁর স্মৃতির রেখা ‘ নামক দিনপঞ্জি বা ‘ অপ্রকাশিত দিনলিপি ‘ – তে ‘ আরণ্যক ‘ – এর বহু কাহিনি ও ঘটনা পরপর সাজানো আছে । অনেক ক্ষেত্রেই উপন্যাসে তার অবিকল অনুসরণ ঘটেছে । যেহেতু গোটা উপন্যাসটাই অনেক ক্ষেত্রে সত্যচরণের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতিফলন , তাই তাকে ডায়েবিধর্মী বলে মনে হতেই পারে । কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা ডায়েরি নয় । ‘স্মৃতির রেখা’র সঙ্গে ‘ আরণ্যক ‘ – এর যা পার্থক্য ডায়েরির সঙ্গে উপন্যাসেরও সেই পার্থক্য। এবার উপন্যাস হিসেবে ‘ আরণ্যক’এর শিল্পসাৰ্থকতা বিচার্য স্বয়ং লেখক একে নিশ্চিতভাবেই ‘ উপন্যাস ‘ আখ্যা দিয়েছেন , তাই এর উপন্যাসধর্মটির সন্ধান প্রয়োজন । উপন্যাসের পরিচিত ও প্রচলিত কাঠামো এখানে হয়তো সব সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
ড . শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন , উপন্যাসটির পরিকল্পনার অভিনবত্ব বিস্ময়কর – ইহা সাধারণ উপন্যাস হইতে সম্পূর্ণ নূতন প্রকৃতির । প্রকৃতির যে সুক্ষ্ম কবিত্বপূর্ণ অনুভূতি বিভূতিভূষণের উপন্যাসের গৌরব তাহ্য এই উপন্যাসে চরম উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে । প্রকৃতি এখানে মুখ্য মানুষ গৌণ । ” ( ” বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা ‘ )
সাধারণভাবে উপন্যাসে মানবপ্রাধান্য হয় । কারণ , আগেই বলা হয়েছে যে , উপন্যাস মুখ্যত মানবজীবনের কাহিনি । এই উপন্যাসেও প্রকৃতি মানবসম্পর্ক – বহির্ভূত নয় । এখানে মানুষ এবং প্রকৃতি অন্তরঙ্গসূত্রে প্রথিত । ‘ আরণ্যক ‘ অর্থ অরণ্য – সম্পর্কিত । ভাই অরণাপ্রকৃতি এবং অরণ্যমানুষ এখানে সমান গুরুত্বের দাবিদার । এখানে কখনো প্রকৃতি মানুষের হয়ে কথা বলেছে আবার কোথাও মানুষই প্রকৃতির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে । কিন্তু বিভূতিভূষণের নায়ক সত্যচরণ তো ‘ প্রস্তাবনা ‘ – তে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিল , ‘ শুধু বনপ্রান্তর নয় , কত ধরণের মানুষ দেখিয়াছিলাম । ‘ শুধু বনপ্রাপ্তরের বর্ণনায় উপন্যাস হয় না , মানুষই বনপ্রান্তরের স্রষ্টা , আস্বাদক , মানুষই অরণ্যপ্রকৃতিকে সজীব করে তোলে । তাই ‘ আরণ্যক ‘ – এ শেষ পর্যন্ত মানুষেরই প্রাধান্য । অরণ্য প্রকৃতিকে ছেড়ে আসার জন্য সভাচরণের যত না কষ্ট হয়েছে , তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়েছে অরণ্যলালিত মানুষগুলিকে ছেড়ে আসার জন্য । নাঢ়া লবটুলিয়ার অরণ্যপ্রান্তরকে বিনষ্ট করার জন্য সত্যচরণের মনে একটা অপরাধবোধ ছিল , আর মমত্ববোধ ছিল সেখানকার মানুষগুলির প্রতি ‘ কেমন আছে কুস্তা , কত বড় হইয়া উঠিয়াছে সুরডিয়া , মটুবনাথের টোল আজও আছে কিনা , ভানুমতী তাহাদের সেই শৈলবেষ্টিত আরণ্যভূমিতে কি করিতেছে , রাখালবাবুর স্ত্রী , ধ্রুবা , গিরিধারীলাল , কে জানে এতকাল পরে কে কেমন অবস্থায় আছে ।… আর মনে হয় মাঝে মাঝে মঞ্চীর কথা । অনুতপ্তা মঞ্চী কি আবার স্বামীর কাছে ফিরিয়াছে , না আসামের চাবাগানে চায়ের পাতা তুলিতেছে আজও । কতকাল তাহাদের আর খবর রাখি না ।
১৯২৭ – এর ৩০ নভেম্বর – এর দিনপঞ্জিতে ( ‘ স্মৃতির রেখা ‘ ) বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাস – ভাবনার পরিচয় দেন এইভাবে, ‘ মানুষের সত্যিকার ইতিহাস কোথায় লেখা আছে । জগতের বড় বড় ঐতিহাসিকগণ যুদ্ধবিগ্রহের ঝল্পনায় , সম্রাট সম্রাজ্ঞী সেনাপতি মন্ত্রীদের সোনালী পোশাকের জাঁকজমকে দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলে গিয়েছেন । পথের ধারে আমগাছে তাদের পুঁটলি বাঁধা ছাড় কবে ফুরিয়ে গেল , কবে তার শিশুপুত্র প্রথম পাখী দেখে সানন্দে মুগ্ধ হয়ে ডাগর শিশুচোখে চেয়েছিল , সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট থেকে ঘোড়া কিনে এলে পল্লীর মধ্যবিত্ত ছেলে তার মায়ের মনে কোথায় ঢেউ বইয়েছিল — দু হাজার বছরের ইতিহাসে সে সব কথা লেখা নেই — থাকলেও বড় কম । এরপরেই আরও একধাপ এগিয়ে তিনি বলেন , ‘ কিন্তু আরও সুক্ষ্ম , আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই । আজকের তুচ্ছতা হাজার বছর পরের মহাসম্পদ । মানুষ মানুষের বুকের কথা শুনতে চায় । ‘ একজন মহৎ স্রষ্টার এ এক অসামান্য আত্মোদঘাটন । ‘পথের পাঁচালী ‘ বা ‘ আরণ্যক ‘ – এর স্রষ্টাকে এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে । রাজারাজড়ার কাহিনি বা নিছক প্রকৃতিবর্ণনাকে তিনি উপন্যাস বলে মনে করেন না । উপন্যাস বলবে মানুষের বুকের কথা , উপন্যাসে মানুষের প্রাণের স্পন্দন শোনা যাবে , ‘ আরণ্যক ‘ – এ এই দুয়েরই উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে ।
ড . রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ‘ আরণ্যক ‘ – এর উপন্যাসলক্ষণ আলোচনা প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন তা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে , ‘ একখানি সার্থক উপন্যাসের কাহিনির তিনটি বিশেষ গুণ — ব্যাপকতা , গভীরতা ও অখণ্ডতা । যে কাহিনির মধ্যে জীবনের বিচিত্র ব্যাপার স্পষ্ট হইয়া ওঠে নাই , সে কাহিনি জীবনের অন্তস্তলে প্রবেশ করে নাই সে কাহিনিকে সার্থক উপন্যাস বলি না । তৃতীয়ত , সার্থক উপন্যাসের কাহিনি এক অখণ্ড বস্তু , ইহাতে মানুষের ভাব , চিত্তা ও কর্মের বিচিত্রমুখিতা পাঠকের সামনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুষম জগৎ উপস্থিত করে । ইহার ছোট – বড় ঘটনা ও চরিত্র , ইহার বিভিন্ন পরিবেশ , ক্রমশ মনুষ্য জীবনের একটি মহান সত্যকে উদ্ঘাটিত করে । যে কাহিনিতে এই অখণ্ডতা নাই , সেই কাহিনিতে পরিণতিও নাই , অর্থাৎ সে কাহিনি অপরিণত । বস্তুত কাহিনির অখগুতা মূলত ঔপন্যাসিকের দৃষ্টির অখণ্ডতা । ( ভূমিকা , ‘ বিভূতি রচনাবলী ‘ , পঞ্চম )।
ইচ্ছে করেই এই উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ রাখা হল । কারণ , একটি সার্থক উপন্যাসের মূল লক্ষণগুলিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে । ‘ আরণ্যক ‘ – এ নায়ক নিঃসন্দেহে সত্যচরণ , কিন্তু প্রচলিত অর্থে কোনো নায়িকার সন্ধান এখানে পাওয়া যাবে না । অনেক নারীচরিত্রের সঙ্গেই একের পর এক তার পরিচয় হয়েছে , অনেকের প্রতি মমত্ববোধ করেছে । কিন্তু কারো সঙ্গেই একাত্মতা বোধ করেনি । একমাত্র সাঁওতাল রাজকন্যা ভানুমতী সম্পর্কে তার ক্ষণিকের দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল । লবটুলিয়া ছাড়ার পূর্বমূহূর্তে অন্তত একবার তার মনে হয়েছিল , ‘ এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম । ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম ।… ভানুমতী কালো বটে , কিন্তু এমন নিটোল স্বাস্থ্যবর্তী মেয়ে বাংলাদেশে পাওয়া যায় না । আর ওর ওই সতেজ সরল মন । দয়া আছে , মায়া আছে , স্নেহ আছে তার কত প্রমাণ পাইয়াছি । ..ভাবিতেও বেশ লাগে । কি সুন্দর স্বপ্ন । ” এটা ছিল নিছক স্বপ্নবিলাস । সত্যচরণেরও জানা ছিল যে , ভানুমতীকে নিয়ে ঘর বাঁধা সম্ভব নয় । তা ছাড়া সে অরণ্যমহলের ভূমিপুত্র নয় , এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সে আসেওনি । তাই নায়ক – নায়িকার টানাপোেড়নের মধ্য দিয়ে সাধারণ উপন্যাসের কাহিনি যেভাবে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়, এখানে তার নিদর্শন নেই ।
এই উপন্যাসের কাহিনির মধ্যে রয়েছে মহাকাব্যিক বিস্তার । তাই এখানে সত্যচরণ নায়ক হলে নায়িকা হন বিশাল অরণ্যপ্রকৃতি । এই প্রকৃতি নারীর মতোই রহস্যময় এবং জটিল । ধীরে ধীরে সত্যচরণের সামনে সে নিজের রহস্য যেন উন্মোচিত করতে থাকে । ‘ কত রূপে কত সাজেই যে বন্য প্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া আমাকে ভুলাইল — কত সন্ধ্যা আসিল অপূর্ব্ব রক্তমেঘের মুকুট মাথায় , দুপুরের খরতর রৌদ্র আসিল উন্মাদিনী ভৈরবীর বেশে , গভীর নিশীথে জ্যোৎস্নাবরণী সুরসুন্দরীর সাজে হিমস্নিগ্ধ বনকুসুমের সুবাস মাখিয়া , আকাশভরা তারার মালা গলায় অন্ধকার বজনীতে কালপুরুষের আগুনের খড়গ হাতে দিগ্বিদিক ব্যাপিয়া বিরাট কালীমূর্তিতে । ‘ ( ‘ আরণ্যক ‘ , দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ , তৃতীয় অধ্যায় )
প্রকৃতির বিভিন্নরূপ একদিকে যেমন সত্যচরণকে একাধারে বিস্মিত , মুগ্ধ ও শঙ্কিত করেছিল, অপরদিকে প্রকৃতিলালিত মানুষগুলিও তাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয় । কিন্তু কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাই উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয় , তা একই সঙ্গে একটি জাতি ও সভ্যতার উত্থান ও পতনেরও ইতিহাস । রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে সত্যচরণের যে মনে হয়েছিল ‘ আমি , বনোয়ারী সেই বিজয়ী জাতির প্রতিনিধি , বৃদ্ধ দোবরু পান্না , তরুণ যুবক জগরু , তরুণী কুমারী ভানুমতী সেই বিজিত পদদলিত জাতির প্রতিনিধি — উভয় জাতি আমরা এই সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছি ‘ — তা ঐতিহাসিক সত্যেরই প্রতিধ্বনি । রাজা দোবরু পান্নার বিপর্যয়ের মধ্যে ইতিহাসের যে বিরাট ট্র্যাজেডি ‘ পাঠকের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয় — তাই উপন্যাসটিকে মহাকাব্যিক উচ্চতায় তুলে দেয় । এখানেই উপন্যাস হিসেবে ‘ আরণ্যক ‘ – এর সার্থকতা।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. Netaji Subhas Open University- Study Material (PGBG).
2. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- রচনা : ‘আরণ্যক’