Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি ভ্রমণকাহিনি, ডায়েরি নাকি উপন্যাস- আলোচনা কর!

‘আরণ্যক’ সম্পর্কে বিভূতিভূষণ ভূমিকার এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে উপন্যাস। অভিধানে লেখে ‘উপন্যাস’ মানে বানানো গল্প। অভিধানকার পণ্ডিতদের কথা আমরা মানিতে বাধ্য । তবে ‘আরণ্যক’- এর পটভূমি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয় । কুশী নদীর অপরপারে এমন দিগন্ত বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রস্তর পূর্ব্বে ছিল , এখনও আছে । দক্ষিণ ভাগলপুর ও গয়া জেলার বনপাহাড় তো বিখ্যাত। উপন্যাস মানে কেবল ‘ বানানো গল্প ‘ একথা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণযোগ্য নয় । উপন্যাসকে বলা হয় ‘ মানবজীবনের গদ্যময় রূপ ( prose of man’s life )। বাস্তবতার ভিত্তির ওপরই মানবজীবন – কাহিনি দাঁড়িয়ে থাকে , তবে ঔপন্যাসিক অবশ্যই বাস্তবের সঙ্গে কল্পনাকে মিলিয়ে দেন। ‘আরণ্যক’ – এর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে । যে অরণ্যপ্রাপ্তর – এর পটভূমি তা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্যচরণের দেখা প্রকৃতি ও মানুষ আসলে বিভূতিভূষণেরই দেখা । স্মৃতির রেখা’র মতো দিনলিপিতে বর্ণিত নানা ঘটনা , চরিত্র এবং লেখকের মন্তব্য অবিকল ‘ আরণ্যক ‘- এ ব্যবহৃত হয়েছে । তাই ‘ আরণ্যক ‘ বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। 
‘আরণ্যক’ – এর উপন্যাসলঞ্চণ বিচারের আগে এক ‘ ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘ বা ‘ ডায়েরি ‘ বলা চলে কিনা সে আলোচনা সেরে নেওয়া যেতে পারে । লেখকের বোধ হয় মনে হয়েছিল যে , সত্যচরণের জঙ্গলমহলে প্রবেশ ও প্রস্থান পাঠকের কাছে একজন ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতা বলে মনে হতে পারে । নিজের জিনিসপত্র নিয়ে একদিন সভাচরণের বি.এন.ডব্লিউ রেলওয়ের একটি ছোটো স্টেশনে নামা , নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা, তারপর একদিন বিদায়গ্রহণের মধ্যে যেন ভ্রমণকাহিনির স্বভাবধর্ম আছে । ভ্রমণকারীর মতোই যেন সত্যচরণ একের পর এক নানা ঘটনা ও চরিত্রকে নিরাসক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং বিশ্লেষণও করেছে । কোনোকিছুর সঙ্গেই স্থায়ী একাত্মবোধ স্থাপন করেনি। কিন্তু নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সত্যচরণ লবটুলিয়া – আজিমবাদ – ইসমাইলপুরে যায়নি , সে গিয়েছিল চাকরি নিয়ে । চাকরি একটা নির্দিষ্ট বন্ধন , যথার্থ ভ্রমণকারী কোনো নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতার শর্তে আবদ্ধ থাকে না । সে নিজের পছন্দমতো পরিভ্রমণ করে বেড়ায় । দীর্ঘকাল কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকলে ভ্রমণকারীর সচলতা নষ্ট হয়ে যায়।
আরণ্যক ‘ উপন্যাসের নায়ক সভ্যচরণ তার নিয়োগকর্তা জমিদারের প্রায় পঁচিশ হাজার বিঘে জঙ্গলমহালের প্রজাবিলির দায়িত্ব নিয়ে এসেছিল । দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত স্থানত্যাগের স্বাধীনতা তার ছিল না । তাই ভ্রমণবৃত্তাত্তের চলমানতা আলোচ্য গ্রন্থে নেই । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে লেখকের খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতার সম্মিলিত রূপ এই রচনা । এটা ভ্রমণকাহিনির লক্ষণ নয় । ‘ ডায়েরি ‘ কথাটিও ‘ আরণ্যক ‘ প্রসঙ্গে স্বয়ং লেখক ব্যবহার করেছেন । ডায়েরি বা দিনপঞ্জিতে প্রতিটি নির্দিষ্ট দিনে লেখকের অভিজ্ঞতা বা তাঁর মনোভাব বর্ণিত হয় । প্রত্যেকটি দিনের কাহিনিই আলাদা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ । কিন্তু ‘ আরণ্যক ‘ – এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি । আঠারোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই বৃহৎ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যচরণ । তাকে কেন্দ্র করেই সমস্ত ঘটনা আবর্তিত হয়েছে এবং কাহিনি পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে । সত্যচরণের দিনওয়ারি অভিজ্ঞতা এখানে নেই , থাকার কথাও নয় । তাই একে ‘ ডায়েরি ‘ হিসেবে চিহ্নিত করাও সম্ভব নয় । তবে ‘ আরণ্যক ‘ প্রসঙ্গে লেখকের মনে দিনপঞ্জির কথা মনে হওয়ার একটি কারণ থাকতে পারে । তাঁর স্মৃতির রেখা ‘ নামক দিনপঞ্জি বা ‘ অপ্রকাশিত দিনলিপি ‘ – তে ‘ আরণ্যক ‘ – এর বহু কাহিনি ও ঘটনা পরপর সাজানো আছে । অনেক ক্ষেত্রেই উপন্যাসে তার অবিকল অনুসরণ ঘটেছে । যেহেতু গোটা উপন্যাসটাই অনেক ক্ষেত্রে সত্যচরণের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতিফলন , তাই তাকে ডায়েবিধর্মী বলে মনে হতেই পারে । কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা ডায়েরি নয় । ‘স্মৃতির রেখা’র সঙ্গে ‘ আরণ্যক ‘ – এর যা পার্থক্য ডায়েরির সঙ্গে উপন্যাসেরও সেই পার্থক্য। এবার উপন্যাস হিসেবে ‘ আরণ্যক’এর শিল্পসাৰ্থকতা বিচার্য স্বয়ং লেখক একে নিশ্চিতভাবেই ‘ উপন্যাস ‘ আখ্যা দিয়েছেন , তাই এর উপন্যাসধর্মটির সন্ধান প্রয়োজন । উপন্যাসের পরিচিত ও প্রচলিত কাঠামো এখানে হয়তো সব সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না । 
ড . শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন , উপন্যাসটির পরিকল্পনার অভিনবত্ব বিস্ময়কর – ইহা সাধারণ উপন্যাস হইতে সম্পূর্ণ নূতন প্রকৃতির । প্রকৃতির যে সুক্ষ্ম কবিত্বপূর্ণ অনুভূতি বিভূতিভূষণের উপন্যাসের গৌরব তাহ্য এই উপন্যাসে চরম উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে । প্রকৃতি এখানে মুখ্য মানুষ গৌণ । ” ( ” বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা ‘ )
সাধারণভাবে উপন্যাসে মানবপ্রাধান্য হয় । কারণ , আগেই বলা হয়েছে যে , উপন্যাস মুখ্যত মানবজীবনের কাহিনি । এই উপন্যাসেও প্রকৃতি মানবসম্পর্ক – বহির্ভূত নয় । এখানে মানুষ এবং প্রকৃতি অন্তরঙ্গসূত্রে প্রথিত । ‘ আরণ্যক ‘ অর্থ অরণ্য – সম্পর্কিত । ভাই অরণাপ্রকৃতি এবং অরণ্যমানুষ এখানে সমান গুরুত্বের দাবিদার । এখানে কখনো প্রকৃতি মানুষের হয়ে কথা বলেছে আবার কোথাও মানুষই প্রকৃতির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে । কিন্তু বিভূতিভূষণের নায়ক সত্যচরণ তো ‘ প্রস্তাবনা ‘ – তে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিল , ‘ শুধু বনপ্রান্তর নয় , কত ধরণের মানুষ দেখিয়াছিলাম । ‘ শুধু বনপ্রাপ্তরের বর্ণনায় উপন্যাস হয় না , মানুষই বনপ্রান্তরের স্রষ্টা , আস্বাদক , মানুষই অরণ্যপ্রকৃতিকে সজীব করে তোলে । তাই ‘ আরণ্যক ‘ – এ শেষ পর্যন্ত মানুষেরই প্রাধান্য । অরণ্য প্রকৃতিকে ছেড়ে আসার জন্য সভাচরণের যত না কষ্ট হয়েছে , তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়েছে অরণ্যলালিত মানুষগুলিকে ছেড়ে আসার জন্য । নাঢ়া লবটুলিয়ার অরণ্যপ্রান্তরকে বিনষ্ট করার জন্য সত্যচরণের মনে একটা অপরাধবোধ ছিল , আর মমত্ববোধ ছিল সেখানকার মানুষগুলির প্রতি ‘ কেমন আছে কুস্তা , কত বড় হইয়া উঠিয়াছে সুরডিয়া , মটুবনাথের টোল আজও আছে কিনা , ভানুমতী তাহাদের সেই শৈলবেষ্টিত আরণ্যভূমিতে কি করিতেছে , রাখালবাবুর স্ত্রী , ধ্রুবা , গিরিধারীলাল , কে জানে এতকাল পরে কে কেমন অবস্থায় আছে ।… আর মনে হয় মাঝে মাঝে মঞ্চীর কথা । অনুতপ্তা মঞ্চী কি আবার স্বামীর কাছে ফিরিয়াছে , না আসামের চাবাগানে চায়ের পাতা তুলিতেছে আজও । কতকাল তাহাদের আর খবর রাখি না ।
১৯২৭ – এর ৩০ নভেম্বর – এর দিনপঞ্জিতে ( ‘ স্মৃতির রেখা ‘ ) বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাস – ভাবনার পরিচয় দেন এইভাবে, ‘ মানুষের সত্যিকার ইতিহাস কোথায় লেখা আছে । জগতের বড় বড় ঐতিহাসিকগণ যুদ্ধবিগ্রহের ঝল্পনায় , সম্রাট সম্রাজ্ঞী সেনাপতি মন্ত্রীদের সোনালী পোশাকের জাঁকজমকে দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলে গিয়েছেন । পথের ধারে আমগাছে তাদের পুঁটলি বাঁধা ছাড় কবে ফুরিয়ে গেল , কবে তার শিশুপুত্র প্রথম পাখী দেখে সানন্দে মুগ্ধ হয়ে ডাগর শিশুচোখে চেয়েছিল , সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট থেকে ঘোড়া কিনে এলে পল্লীর মধ্যবিত্ত ছেলে তার মায়ের মনে কোথায় ঢেউ বইয়েছিল — দু হাজার বছরের ইতিহাসে সে সব কথা লেখা নেই — থাকলেও বড় কম । এরপরেই আরও একধাপ এগিয়ে তিনি বলেন , ‘ কিন্তু আরও সুক্ষ্ম , আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই । আজকের তুচ্ছতা হাজার বছর পরের মহাসম্পদ । মানুষ মানুষের বুকের কথা শুনতে চায় । ‘ একজন মহৎ স্রষ্টার এ এক অসামান্য আত্মোদঘাটন । ‘পথের পাঁচালী ‘ বা ‘ আরণ্যক ‘ – এর স্রষ্টাকে এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে । রাজারাজড়ার কাহিনি বা নিছক প্রকৃতিবর্ণনাকে তিনি উপন্যাস বলে মনে করেন না । উপন্যাস বলবে মানুষের বুকের কথা , উপন্যাসে মানুষের প্রাণের স্পন্দন শোনা যাবে , ‘ আরণ্যক ‘ – এ এই দুয়েরই উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে । 
ড . রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ‘ আরণ্যক ‘ – এর উপন্যাসলক্ষণ আলোচনা প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন তা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে , ‘ একখানি সার্থক উপন্যাসের কাহিনির তিনটি বিশেষ গুণ — ব্যাপকতা , গভীরতা ও অখণ্ডতা । যে কাহিনির মধ্যে জীবনের বিচিত্র ব্যাপার স্পষ্ট হইয়া ওঠে নাই , সে কাহিনি জীবনের অন্তস্তলে প্রবেশ করে নাই সে কাহিনিকে সার্থক উপন্যাস বলি না । তৃতীয়ত , সার্থক উপন্যাসের কাহিনি এক অখণ্ড বস্তু , ইহাতে মানুষের ভাব , চিত্তা ও কর্মের বিচিত্রমুখিতা পাঠকের সামনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুষম জগৎ উপস্থিত করে । ইহার ছোট – বড় ঘটনা ও চরিত্র , ইহার বিভিন্ন পরিবেশ , ক্রমশ মনুষ্য জীবনের একটি মহান সত্যকে উদ্ঘাটিত করে । যে কাহিনিতে এই অখণ্ডতা নাই , সেই কাহিনিতে পরিণতিও নাই , অর্থাৎ সে কাহিনি অপরিণত । বস্তুত কাহিনির অখগুতা মূলত ঔপন্যাসিকের দৃষ্টির অখণ্ডতা । ( ভূমিকা , ‘ বিভূতি রচনাবলী ‘ , পঞ্চম )।
ইচ্ছে করেই এই উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ রাখা হল । কারণ , একটি সার্থক উপন্যাসের মূল লক্ষণগুলিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে । ‘ আরণ্যক ‘ – এ নায়ক নিঃসন্দেহে সত্যচরণ , কিন্তু প্রচলিত অর্থে কোনো নায়িকার সন্ধান এখানে পাওয়া যাবে না । অনেক নারীচরিত্রের সঙ্গেই একের পর এক তার পরিচয় হয়েছে , অনেকের প্রতি মমত্ববোধ করেছে । কিন্তু কারো সঙ্গেই একাত্মতা বোধ করেনি । একমাত্র সাঁওতাল রাজকন্যা ভানুমতী সম্পর্কে তার ক্ষণিকের দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল । লবটুলিয়া ছাড়ার পূর্বমূহূর্তে অন্তত একবার তার মনে হয়েছিল , ‘ এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম । ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম ।… ভানুমতী কালো বটে , কিন্তু এমন নিটোল স্বাস্থ্যবর্তী মেয়ে বাংলাদেশে পাওয়া যায় না । আর ওর ওই সতেজ সরল মন । দয়া আছে , মায়া আছে , স্নেহ আছে তার কত প্রমাণ পাইয়াছি । ..ভাবিতেও বেশ লাগে । কি সুন্দর স্বপ্ন । ” এটা ছিল নিছক স্বপ্নবিলাস । সত্যচরণেরও জানা ছিল যে , ভানুমতীকে নিয়ে ঘর বাঁধা সম্ভব নয় । তা ছাড়া সে অরণ্যমহলের ভূমিপুত্র নয় , এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সে আসেওনি । তাই নায়ক – নায়িকার টানাপোেড়নের মধ্য দিয়ে সাধারণ উপন্যাসের কাহিনি যেভাবে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়, এখানে তার নিদর্শন নেই ।
এই উপন্যাসের কাহিনির মধ্যে রয়েছে মহাকাব্যিক বিস্তার । তাই এখানে সত্যচরণ নায়ক হলে নায়িকা হন বিশাল অরণ্যপ্রকৃতি । এই প্রকৃতি নারীর মতোই রহস্যময় এবং জটিল । ধীরে ধীরে সত্যচরণের সামনে সে নিজের রহস্য যেন উন্মোচিত করতে থাকে । ‘ কত রূপে কত সাজেই যে বন্য প্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া আমাকে ভুলাইল — কত সন্ধ্যা আসিল অপূর্ব্ব রক্তমেঘের মুকুট মাথায় , দুপুরের খরতর রৌদ্র আসিল উন্মাদিনী ভৈরবীর বেশে , গভীর নিশীথে জ্যোৎস্নাবরণী সুরসুন্দরীর সাজে হিমস্নিগ্ধ বনকুসুমের সুবাস মাখিয়া , আকাশভরা তারার মালা গলায় অন্ধকার বজনীতে কালপুরুষের আগুনের খড়গ হাতে দিগ্বিদিক ব্যাপিয়া বিরাট কালীমূর্তিতে । ‘ ( ‘ আরণ্যক ‘ , দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ , তৃতীয় অধ্যায় )
প্রকৃতির বিভিন্নরূপ একদিকে যেমন সত্যচরণকে একাধারে বিস্মিত , মুগ্ধ ও শঙ্কিত করেছিল, অপরদিকে প্রকৃতিলালিত মানুষগুলিও তাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয় । কিন্তু কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাই উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয় , তা একই সঙ্গে একটি জাতি ও সভ্যতার উত্থান ও পতনেরও ইতিহাস । রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে সত্যচরণের যে মনে হয়েছিল ‘ আমি , বনোয়ারী সেই বিজয়ী জাতির প্রতিনিধি , বৃদ্ধ দোবরু পান্না , তরুণ যুবক জগরু , তরুণী কুমারী ভানুমতী সেই বিজিত পদদলিত জাতির প্রতিনিধি — উভয় জাতি আমরা এই সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছি ‘ — তা ঐতিহাসিক সত্যেরই প্রতিধ্বনি । রাজা দোবরু পান্নার বিপর্যয়ের মধ্যে ইতিহাসের যে বিরাট ট্র্যাজেডি ‘ পাঠকের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয় — তাই উপন্যাসটিকে মহাকাব্যিক উচ্চতায় তুলে দেয় । এখানেই উপন্যাস হিসেবে ‘ আরণ্যক ‘ – এর সার্থকতা।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. Netaji Subhas Open University- Study Material (PGBG).
2. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- রচনা : ‘আরণ্যক’

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.