বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শনের নাম- চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। চর্যাপদগুলো হলো কতকগুলো গানের সংকলন। সেগুলো গীত আকারে বিভিন্ন মাঙ্গলিক বা আচার অনুষ্ঠানে গাওয়া হতো। চর্যাপদের বিষয়বস্তু হলো- বৌদ্ধ ধর্ম মতে সাধনভজনের তত্ত্ব প্রকাশ। চর্যাপদগুলো রচনা করেন- বৌদ্ধ সহজিয়া গণ।
‘চর্যাপদ’ একটি বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দ। চর্যাপদ শব্দের অর্থ যা আচরণীয় ও অনাচরণীয়, পালনীয় ও বর্জনীয়, কি করা উচিত ও কী করা অনুচিত তার নিয়মাবলি।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, তাঁর ‘বৌদ্ধগান ও দোহার’ মুখবন্ধে লিখেছেন- যখন চারপাশে বাংলা স্কুল বসানো হচ্ছিল এবং লোকে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়, বোধদয়, চরিতাবলী, কথামালা পড়িয়া বাংলা শিখছিল, তখন তারা মনে করেছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ই বাংলা শিখেছিল এবং তিনিই বাংলা ভাষার জন্মদাতা। কারণ তারা ইংরেজির অনুবাদ মাত্র পড়িত, বাংলা ভাষার যে আবার সাহিত্য আছে এবং তার যে আবার একটা ইতিহাস আছে এটা কারো ধারণা ছিল না।
…ক্রমে রামগতি ন্যায়রন্ত মহাশয়ের ‘বাঙালা ভাষার ইতিহাস’ ছাপা হলো। তাতে কাশীদাস, কৃত্তিবাস, কবিকঙ্কন প্রভৃতি কয়েকজন বাংলা ভাষার প্রাচীন কবির নাম লেখা হলো। সবার মনে হলো বাংলা ভাষায় তিনশত বছর পূর্বে খানকতক কাব্য লেখা হয়েছে। তাও এমন কিছু নয়, প্রায়ই সংস্কৃতের অনুবাদ। এই হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষিত বাঙালির ধারণা।
কিন্তু ধারণাটা যেটাই হোক না কেন- এ কথাও সত্য যে, ঐ সময়টা ছিলো বাঙালির বিকাশের যুগ, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তার অনুসন্ধিৎসা ও কৌতুহল তখন বিচিত্রমুখী হয়ে উঠেছে। এই বিচিত্র অনুসন্ধিৎসার অঙ্গ হিসেবেই আমরা লক্ষ করি, বৌদ্ধ ধর্মের ইতিবৃত্ত ও সাহিত্য সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান শুরু হয়েছে তখন।
এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহে প্রথম প্রবৃত্ত হন রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র। সম্ভবত তিনিই প্রথম নেপাল যাত্রা করে অনেকগুলো বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্যের পুঁথি প্রাপ্ত হন এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘Sanskrit Buddhist literature in Nepal’ নাম দিয়ে সে সবের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি তা প্রকাশ করে যে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
শাস্ত্রী মশাইয়ের ইচ্ছা ছিল যে, ‘নেপালে হিন্দু রাজার অধীনে বৌদ্ধধর্ম কিরূপে চলিতেছে দেখিতে যাইব।’ সে সময় শাস্ত্রীমশাই বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। যে ভারতে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব সেই ভারতের মাটি থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটি তার কাছে অসম্ভব ঘটনা মনে হয়েছিল। তার এটাই মনে হয়েছিল যে, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ছদ্মবেশে বৌদ্ধধর্ম এখানে আত্মগোপন করে আছে।
এ ধারণা সত্য প্রমাণিত করার জন্য তিনি তিনবার নেপালে যান, ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে দুবার এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে।
শেষবার ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রয়েল লাইব্রেরিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কয়েকটা পুঁথি দেখতে পেল। একখানির নাম চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, তাতে কতগুলো কীর্তনের গান আছে ও তাহার সংস্কৃত টীকা আছে। গানগুলো বৈষ্ণবদের কীর্তনের মতো, গানের নাম চর্যাপদ। পরবর্তীতে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যিনি চর্যাপদের আবিষ্কারক, তিনি চর্যাপদগুলো সম্পাদনা করে কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ, কৃষ্ণপাদের দোহা ও ডাকার্ণব- এ চারটি পুঁথি একত্রে ‘হাজার পুরাণ বাংলাভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করেন। এই হলো চর্যাপদ আবিষ্কারের পেছনের ঘটনা।
সহায়ক গ্রন্থ:
১. মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত): চর্যাগীতিকা
২. গোপাল হালদার: বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা (১ম খণ্ড)
৩. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্: বাংলা সাহিত্যের কথা
৪. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: Origin and Development of Bengali Language
৫. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১-২ খণ্ড)
৬. দীনেশচন্দ্র সেন: বঙ্গভাষা ও সাহিত্য
৭. সুকুমার সেন: বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১-২খণ্ড)
৮. মাহবুবুল আলম: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
৯. ড. সৌমিত্র শেখর: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা