Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

নীলদর্পণ নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি- আলোচনা কর

ভূমিকা: বাংলা নাটকের কয়েকজন বিশিষ্ট নাট্যকারের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র অন্যতম, কারো কারো মতে বাংলা নাটকের প্রাথমিক যুগে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকের সূচনা করেন, তেমনি দীনবন্ধু মিত্র বাস্তব জীবনচিত্র সংবলিত সমসাময়িক সমাজ জীবনের অতি উজ্জ্বল আলেখ্য রচনা করেছেন। ফলে দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম জীবনে তিনি কিছুদিন কবি ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য হয়ে রঙ্গরসের কবিতা রচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন, পরে সামান্য কিছু কাব্য কবিতাও লিখেছিলেন। কিন্তু তার প্রধান খ্যাতি নাটকের জন্যে। নাট্যকার হিসেবেই দীনবন্ধু মিত্রের পরিচয়। দরদী মানুষের মুখের কথা তো লেখকই তুলে আনবেন, এটাই সমাজের প্রত্যাশা। সমাজের প্রত্যাশা পূরণ হলে সমাজ তাঁকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে বুকের ভেতর খোদাই করে রাখে। তেমনি একটি সাহিত্যকর্ম ‘নীলদর্পণ’। ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) বেনামীতে মুদ্রিত দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম নাটক। দীনবন্ধু মিত্রের উদ্দেশ্য ছিল নাটকের মধ্যে দিয়ে সাধারণ চাষী প্রজাদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব সম্মত ছবি সবার সামনে তুলে ধরা এবং ধরেছেনও তাই। নাটকটিকে দর্পণের মতো ব্যবহার করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য বর্গ ও সাধু ইংরেজদের তিনি দেখাতে চেয়েছেন অসাধু ইংরেজ নীলকর সাহেবদের চরিত্রকে। দর্পণের সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এই নাটকটির দিকে তাকালে ইংরেজ জাতি নিজেদের কলঙ্কময় দিকটা দেখবেন এবং সংশোধনের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে উঠবেন। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই নাটকটি রচনা করা হয়। তাই নাটকটির সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি হয়ে ধরা পড়েছে।

নীলদর্পণ নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি

সমালোচকেরা বলেছেন, এই নীলদর্পণ নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি। সমাজের নানান চিত্র দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ফলে নীলদর্পণ নাটকটি হয়ে উঠেছে মহামূল্যবান। নীলদর্পণ নাটকে সাহিত্যিক মূল্য যতোটা না বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, তার চেয়ে হাজার-গুণ বেশি নীলদর্পণ নাটকে সামাজিক মূল্যটা প্রাধান্য পেয়েছে। নীলদর্পণ নাটকে সমাজই মূখ্য বিষয়, সাহিত্যিক মূল্য সেখানে গৌণ।
দীনবন্ধু তাঁর পিতৃদত্ত নাম নয়— তাঁর নাম গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। কলুটোলা (পরে হেয়ার স্কুল নাম হয়) স্কুলের সতীর্থরা গন্ধর্ব- এর অপভ্রংশ ‘গন্ধ-গন্’ করে তাঁকে বিব্রত করতো, সেজন্য গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র নাম পাল্টে দীনবন্ধু মিত্র নাম নিতে হল। কিন্তু তাঁর প্রথম নাটক নীলদর্পণে (নীলদর্পণং/নাটকং) দীনবন্ধু নামটাও তিনি উল্লেখ করেননি।
১৮৬০ সালের একজন বাঙালি রাজকর্মচারীর পক্ষে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ সহজ কথা ছিল না। তবু দীনবন্ধু বিবাদচিত্রের সত্যনিষ্ঠ দর্পণ বেঁধেছিলেন। মেঘনার বুকে নৌকায় নীলদর্পণ রচনারত দীনবন্ধুর মৃত্যু হলে সত্য দর্পণখানি চিরতরে হারিয়ে যেত। ভাগ্যক্রমে দীনবন্ধু আর নীলদর্পণ রক্ষা পাওয়াতে বাংলা নাটকের একটি উজ্জ্বল লক্ষণ আর রাজনৈতিক ইতিহাস সম্বলিত একটি মূল্যবান দলিল রক্ষা পেল। ১৮৬০ এর সেপ্টেম্বর মাসে ( শকাব্দ ১৭৮২ , ২ রা আশ্বিন ) নীলদর্পণ / নাটকং ঢাকার বালা বাজার বাঙ্গালাযন্ত্রে রামচন্দ্র ভৌমিক কর্তৃক মুদ্রিত হয়েছিল।
নীলদর্পণ উদ্দেশ্যমূলক রচনা। অকৃত্রিম সহানুভূতিশীলতা, স্বদেশপ্রীতি ও সেন্টিমেন্ট প্রবণতার উত্তেজনায় ঈশ্বরগুপ্তের ভাবশিষ্য দীনবন্ধু অকস্মাৎ এটি রচনা করেন। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নীলকর-ব্যবসায়ী ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না কিন্তু পরোক্ষ সম্পর্কের আড়ালে নীলকরদের সঙ্গে ইংরেজ রাজকর্মচারীর ভালমন্দ স্বার্থের ঐক্য ছিল। এরা এক জাতি, ঔপনিবেশিক স্বার্থে ঐক্যমত; শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কে যখনই দরকষাকষি হতো তখন ব্যবসায়ী নীলকররা রাজপ্রতিনিধিদের প্রলুব্ধ করতো নানা উপঢৌকনে। প্রলুব্ধ মুগ্ধ ইংরেজ কর্মচারী বিবেককে বিসর্জন দিত। ইংরেজ রাজকর্মচারী ছ’সাত মাসের সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছে। স্বজন ও স্বদেশের জন্য তাদের ব্যাকুলতা স্বজনের প্রতি নির্ভরশীল করাতো।– ওদের সাহচর্য তাদের প্রয়োজন ছিল। নীলকুঠির জমিদার ব্যবসায়ীরা সপরিবারে স্বজন রাজকর্মচারীদের সঙ্গ দিত আর প্রলুব্ধ ও বিবেক বিসর্জিত রাজপ্রতিনিধির কাছ থেকে ব্যবসায়ী সুযোগগুলো হাতিয়ে নিত। নীলকরদের মনগড়া দুঃখে রাজকর্মী সহজেই অভিভূত হত, কেননা তারা তাদের দৈহিক-আর্থিক প্রয়োজনের সুচারু তদারক করত। এমন সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি উদারতা না থাকলে প্রায় কপর্দকশূন্য নীলকররা কালক্রমে অবিশ্বাস্য ধনপতি এবং সামন্তপ্রভু হতে পারত না। নীলদর্পণে এ সবের ইংগিত ও রেখাচিত্র আছে।
এমন নাটকের নাট্যকার হওয়া নিরাপদ নয়। দীনবন্ধু সে সংকোচেই নাম উল্লেখ করেন নি। কিন্তু গোপন করার জন্য খুব সচেষ্টও বোধ হয় ছিলেন না। নীলদর্পণ বাঙালি গ্রামজীবনের এমন এক অগ্নিমুহূর্তে রচিত যখন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নীলবিরোধী সংগ্রামে শপথসংহত নীলচাষীর এবং বাংলা সরকারের সেক্রেটারি নীলচাষীদের দুঃখ সচেতন (পাদ্রী লং-এর ব্যক্তিগত বন্ধু) সিটনকারের নেতৃত্বে (১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ) নীল কমিশনের কিছুটা উদার সুপারিশ নীলকর দ্বারা অমান্য হয়েছে। বাঙালি জাতীয় চেতনায় তখনো ফারায়জী, সাঁওতাল, কৃষক-বিদ্রোহ এবং মহাবিপ্লবের স্পৃহাগুলো স্মৃতি হয়ে আছে । স্মৃতির এসব অগ্নিকণা গ্রামবাংলাকে তখন উত্তপ্ত ও সংহত করেছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদী বাঙালি নবজাগরণের বিশিষ্ট ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রগতিবাদী ভূমিকায় দীনবন্ধুর বিশ্বাস ছিল। বিধবা বিবাহে, বহুবিবাহ বিরোধিতায় এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রতি দীনবন্ধুর শ্রদ্ধা ছিল। নাগরিক বুদ্ধিবাদ আর গ্রাম্য অর্বাচনীতার মধ্যে দীনবন্ধু বিরোধী সংঘাতকে উৎপন্ন করেন নি। বরং আশ্চর্য রকম বোঝাপড়া করে দুয়ের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। দীনবন্ধুর গ্রাম্যতায় নাগরিকতা অধিক। দীনবন্ধু নাগরিক কৃত্রিমতা আর গ্রাম্য আচরণে দুর্বলতার মধ্যে হাসি মস্করার উপাদানকে সহজেই খুঁজে নিতেন। নীলদর্পণের বিষয়গুণ ও দুঃখ গাঢ়তার জন্য হাসি মস্করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের নাটকগুলি বিষয় অপেক্ষা মেজাজের সমধর্মিতার জন্য অধিক বৈঠকী ও অন্তরঙ্গ মেজাজী  সমসাময়িক জীবনাচরণের মধ্যে মনোমত সরস চরিত্র সন্ধান ও দুর্বলতাকে হাস্যকৌতুকের জনপ্রিয় উপাদান করতে গিয়ে দীনবন্ধু এক বদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ। তাই তিনি সমাজের নানান চিত্র সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছে। ফলে সাহিত্য হয়ে উঠেছে মহামূল্যবান। কিন্তু এক্ষেত্রে নীলদর্পণ নাটকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নীলদর্পণ নাটকে সাহিত্যিক মূল্য যতোটা না বেশি, তার চেয়ে হাজার-গুণ নীলদর্পণ নাটকে সামাজিক মূল্যটা প্রাধান্য পেয়েছে।
নীলদর্পণ নাটকে সমাজই মূখ্য বিষয়, সাহিত্যিক মূল্য সেখানে গৌণ। নীলদর্পণ নাটকের দর্পণখানিতে গ্রামীণ বাংলার অবিকল ছবি ফুটে উঠল। নিপীড়নের স্বচ্ছ ছবির মধ্যে বঙ্গ দেশের মুখ দেখা গেল। বিদেশী নীলকরের লোলুপ অত্যাচারী আচরণগুলি বিশ্বাস্য সংবাদের মত জ্বলজ্বল করে উঠল। এতদিন বুদ্ধিজীবী ‘কলিকাতা বাবুভেয়ারা’ নীলকর নিপীড়নের যে সংবাদ তত্ত্ববোধানী, আলালের ঘরের দুলাল, হিন্দু পেট্রিয়টে পাঠ করে ক্ষণিকের জন্য কৌতূহলী হত তারই উজ্জ্বল অবিকল চিত্র দেখে সেই সংবাদের সত্যতায় নিঃসন্দেহ হল। কিন্তু সর্বাপেক্ষা উত্তেজিত হল নীলকর ব্যবসায়ীরা। বিষয়ের সত্যতা অস্বীকার করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে জন্য তারা যত না সন্ত্রস্ত হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়েছিল নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ দেখে এবং সেই অনুদিত গ্রন্থখানি বিলেতে প্রেরণের কারণে। দেশীয় ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সহযোগিতা লাভের উপায় তাদের জানা ছিল। কিন্তু স্বদেশের ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তারা যে ব্যবসায়ী লাভ লোকসানের ফাঁকিবাজি করছিল, তার তথ্য সন্ধান হলে তাদের পায়ের নিচের মাটি চিরতরে সরে যাবে এ ভয় তাদের অমূলক ছিল না । নীলদর্পণ নাটক সজ্জন ইংরেজ রাজকর্মচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তাদের গোপন পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিল। কিন্তু জমিদার ব্যবসায়ী নীলকরদেরকে এই নাটক বিষধর সদৃশ দংশনে ক্ষিপ্ত করেছিল।
নীলদর্পণ নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো: নীলদর্পণের কোন ঘটনা কোন চরিত্রই দীনবন্ধুর কৃত্রিম সৃজন নয়, শুধু নাটকের বিন্যাসটুকু তাঁর নিজের। সে সময়ের-
ক. নদীয়ার গুয়াতেলির মিত্র পরিবার;
খ. চৌগাছার বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বাঁশবেড়িয়ার বিশ্বনাথ;
গ. আর্চিবল্ড হিল্‌স্‌ কর্তৃক নদীয়ার মাথুর বিশ্বাসের পুত্রবধূ হরমণি অপহরণ (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৯);
ঘ. ঝিনাইদহের নীলকর দেওয়ান মহেশ চট্টোপাধ্যায়;
ঙ. নদীয়া যশোহরের জমির মণ্ডল, হাজিমোল্লা, পাঞ্জুমোল্লা প্রভৃতি কৃষক;
চ. মোল্লাহাটি নীলকুঠির লারমুর, আর্চিবল্ড হিল্স, ফারলং;
ছ. পাদ্রী ডাফ ও পাদ্রী বমভাইস;
জ. নদীয়ার অস্থায়ী ম্যাজিস্ট্রেট ডবলিউ. জে. হার্সেল (১৮৫৯ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে);
ঝ. যশোহরের পুলিশ ইন্সপেক্টর গিরিশচন্দ্র বসু প্রভৃতি।
প্রত্যক্ষ ব্যক্তিসমূহ নীলদর্পণের মধ্যে-
ক. স্বরপুর গ্রামের গোলক বসু পরিবার;
খ. নবীনমাধব , বিন্দুমাধব;
গ. রোগ কর্তৃক ক্ষেত্রমণি অপহরণ;
ঘ. গোপীনাথ;
ঙ. তোরাপ ও অন্যান্য রায়ত এবং সাধুচরণ ও রায়চরণ;
চ. আই . আই . উড , পি.পি. রোগ – বেগুনবেড়ে কুঠির নীলকর;
ছ. ইন্দ্ৰাবাদ জেলখানা দৃশ্যে (চতুর্থ অঙ্ক/ ৩ য় গর্ভাঙ্ক) উল্লিখিত পাদ্রী;
জ. ইন্দ্রাবাদ অমরনগরের প্রাক্তন সজ্জন ম্যাজিস্ট্রেট বলে উল্লিখিত;
ঝ. জেল দারোগা প্রভৃতি বাস্তব মানুষেরাই নাট্য চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া বাংলা গভর্নর জি . পি . গ্র্যান্ট ও সেক্রেটারি সিটনকারের পরোক্ষ উল্লেখ আছে কাহিনীতে।
নীলদর্পণ শুধু নীলকর উৎপীড়নের সমসাময়িকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার দুঃখময় প্রাত্যহিক পল্লীজীবনের করুণচিত্রটি, গ্রামবাংলার ঘনিয়ে আসা অন্ধকার সুন্ধ্যার ছবিটি, স্বরপুর গ্রামখানি, গোলকবসুর একান্নবর্তী ভক্তিস্নেহমাখা পরিবারটি, সাধুচরণের নিকোনো উঠানটি গ্রামখানির আশেপাশের বেত্রাবতী চন্দনবিল, সাঁপোলতলার এক সময়ের শয্যশ্যামল মাঠগুলি এবং শ্যামল বাংলার নীরব দুপুরে স্বাভাবিক রসরসিকতার মধ্যে গৃহবধূদের সিকা গাঁথা আর চুল বিনুনীর গৃহগত মাধুর্যের ছবিখানি সনাতন জীবন সত্যের মতো ফুটে আছে নাটক নীলদর্পণে। এই শ্যামল মনোলোভা, প্রসন্ন প্রকৃতির মধ্যে, তখন মাঝে মধ্যে সংঘর্ষের দূরবর্তী একখণ্ড মেঘ শুধু দেখা দিচ্ছে আভাষে ইঙ্গিতে। বিন্দুমাধব গেছে শহরে, কৌসুলী হয়ে ফিরবে। তার বউ বেতাল পঞ্চাবিংশতি পড়া মেয়ে সরলতা। স্বামীর আবেগবহুল চিঠিগুলি ভালবাসার শাঁখা শোভন হাতে বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে। ক্ষেত্রমণি এসেছে পিতৃগৃহে সিঁথিতে তার টকটকে উজ্জ্বল সিঁদুর। প্রথম সন্তানসম্ভবা ক্ষেত্রমণির লাজরক্তিম মুখখানিতে যেন কচিধানের মাধুর্য। রাইচরণ শ্বশুরালয়ে যাবে বৌকে আনতে। সকলের চিত্তে এক সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষা, শস্যের মাঠে জীবনের স্বপ্নের প্রতিবিম্ব দেখতে সকলেই উন্মুখ।
কিন্তু সে মাঠ, সে জীবন, সে সম্ভাবনাগুলো আর চরিতার্থতা পেল না। যেমন চন্দনবিলে পদ্মফুল ফুটে থাকার মত মোড়লদের আউশ ধানের পালা, দশখান হাল, চল্লিশটা দামড়া গরু সব এক এক করে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মোড়লগৃহের দিকে এখন আর তাকানো যায় না তেমনি স্বরপুর গ্রামখানি, গোলক বসুর মান্য পরিবারটি দেখতে দেখতে নীলকর বিষদংশনে ছারখার হয়ে গেল। গোলক বসু মর্মান্তিক লজ্জায় আত্মহত্যা করলেন, নবীনমাধবের জীবন অকালে ঝরে গেল, বিন্দুমাধবের উচ্চশিক্ষা হল না; সন্তানসম্ভবা ক্ষেত্রমণিকে ধর্ষণ নিপীড়নে হত্যা করে নীলকররূপী অমোঘ নিয়তি গ্রামবাংলার ভাগ্যে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে অনিবার্য করে তুলল। পরিণতিতে ভীতবিহ্বল বিন্দুমাধব মৃত্যুময় অন্ধকার আবর্তের মধ্যে দুঃখের পাঁচালী গাইছে:
“কে হরিল সরোরুহ হইয়া নির্দয় 
শোভাহীন সরোবর অন্ধকারময় 
হেরি সব শবময় শ্মশান সংসার 
পিতামাতা ভ্রাতা দারা মরেছে আমার।” 
সর্বনাশের ধ্বংসলীলায় দাঁড়িয়ে বিন্দুমাধবের সে বিলাপ যত মর্মান্তিক এবং অনাটকোচিত হোক , বিপর্যয়ের অন্তিম গর্ভে নিমগ্ন হওয়ার পূর্বে নাট্যকার বোধ করি এছাড়া উজ্জ্বল কোন বিকল্প আচরণকেই বিশ্বাস্য বলে কল্পনা করতে পারেন। নাটকখানির পাঁচ অংকের আঠারোটি দৃশ্যের প্রায় অর্ধশত চরিত্রের ব্যাপ্তির মধ্যে নাট্যকার এতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভাবনাকে সমসাময়িক আলোড়িত নিপীড়িত আবেগের মধ্যে বিমুগ্ধ হয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই বিমুগ্ধতার মধ্যে প্রত্যক্ষতা, উত্তেজনায় অকৃত্রিম সাহস আছে কিন্তু গভীর স্থির প্রজ্ঞা দ্বারা এ জীবন বিপন্নতা সৃষ্টি ও বিশ্লেষণ করার অপেক্ষা তিনি করেননি। তবু বাংলার গ্রাম, বাংলার মানুষ, বাংলার সনাতন জীবন প্রভৃতি সত্যগুলি স্বাভাবিক এবং আন্তরিক স্রোতের মত বয়ে এসে নীলদর্পণকে স্মরণীয় করে বেঁচে থাকার মতো পলিমাটি দান করেছে। দান করেছে সামাজিক মূল্য, দান করেছে সাহিত্যিক মূল্য।
উপসংহার: নাটকটি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি সমালোচকদের চোখ এড়াতে পারেনি। কেননা, কোনো লেখকই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সমালোচকেরা বলেছেন, এই নীলদর্পণ নাটকের সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সামাজিক মূল্য বেশি। সমাজের নানান চিত্র দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ফলে নীলদর্পণ নাটকটি হয়ে উঠেছে মহামূল্যবান। নীলদর্পণ নাটকে সাহিত্যিক মূল্য যতোটা না বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, তার চেয়ে হাজার-গুণ বেশি নীলদর্পণ নাটকে সামাজিক মূল্যটা প্রাধান্য পেয়েছে। নীলদর্পণ নাটকে সমাজই মূখ্য বিষয়, সাহিত্যিক মূল্য সেখানে গৌণ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদবধ। দৈবাস্ত্র লাভ করবার পর লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের কাছে সেটি কীভাবে পেলেন তা বর্ণনা করে। তিনি জানান লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী

Read More

ইন্দ্রানী সুত কে?

ইন্দ্রাণী শব্দের অর্থ ইন্দ্রের স্ত্রী। সুত অর্থ পুত্র। ইন্দ্রানী সুত হল ইন্দ্রের পুত্র।

Read More
অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.