বাগযন্ত্র: ধ্বনি উৎপাদনের জন্য মানব শরীরের যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে একত্রে বাকযন্ত্র বলে।
বাগযন্ত্রের কাজ দুইটি:
১. জৈবিক কাজ ও
২. মানবিক কাজ।
জৈবিক কাজকে প্রাথমিক কাজও বলা হয়ে থাকে। জৈবিক কাজের প্রধান উদ্দেশ্য মূলত দুইটি:
১. শ্বাসক্রিয়া পরিচালনা করা এবং
২. খাদ্য গ্রহণ করা।
জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্য হলেও সময় ও সভ্যতার বিবর্তনে বাকযন্ত্রের কর্মক্ষমতা হয়েছে ব্যাপ্ত ও প্রসারিত। ধ্বনি উচ্চারণে এগুলি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করে আসছে। তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় মুখ ও গলার সাহায্যেই আমরা ধ্বনি উচ্চারণ করি বা কথা বলি। কিন্তু ধ্বনি উচ্চারণে সম্পূর্ণ ভেতরের প্রত্যঙ্গগুলি ছাড়াও আরো কিছু প্রত্যক্ষ জড়িত। বস্তুত শ্বসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বাতাসের পরিমাণ ও গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষ ধ্বনি উচ্চারণ করে।
বাগযন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ
আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা বাগযন্ত্রকে ১৪ টি ভাগে ভাগ করেছে। এগুলো হলো: ফুসফুস, বায়ুনালী বা শ্বাসনালী, স্বরযন্ত্র, স্বররন্ধ্র, অধিজিহ্বা, আলজিভ, স্বরতন্ত্র, গলনালি, জিহ্বা, তালু, দাঁত, নাক ও চোয়াল। নিম্নে বাগযন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করা হলো।
১. ফুসফুস (Lungs): ফুসফুস বাগযন্ত্রের প্রথম অংশ। বাইরে থেকে নিঃশ্বাস বায়ু প্রথমে ফুসফুসে আসে এবং তারপর ফুসফুসের চাপ থেকে বাতাস সঞ্চালিত হয়ে মানব ভাষার সবচেয়ে বেশি ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এটি সরাসরি ভাষা বা ধ্বনি উৎপাদন না করলেও ভাষা বা ধ্বনি উৎপাদনে সাহায্য করে। তাই বাগ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে ফুসফুসের গুরুত্ব অপরিসীম।
২. শ্বাসনালি বা বায়ুনালি (Trachea): মানবভাষার ধ্বনির প্রাথমিক সংগঠন শ্বাসনালীর মাধ্যমে হয়। বায়ুনালি বা শ্বাশনালীর মধ্য দিয়ে ফুসফুসের বায়ু আসা-যাওয়া করে। শ্বাসনালি সরাসরি কোনো ধ্বনি উৎপাদন না করলেও ধ্বনি উৎপাদনে সাহায্য করে।
৩. স্বরযন্ত্র (Larynx): স্বরযন্ত্র হচ্ছে বাগযন্ত্রের প্রধানতম প্রত্যঙ্গ। স্বরযন্ত্রের ভেতরে থাকা স্বরতন্ত্রী বিভিন্নভাবে কাঁপে এবং এ থেকেই প্রধানত বাগধ্বনি উৎপন্ন হয়। পুরো স্বরযন্ত্রটির গঠন অনেকটা বাক্সের মতন যা কার্টিলেজ ও ক্ষুদ্রপেশী (cartilage and muscle) দ্বারা গঠিত। বাইরে থেকে (বিশেষ করে পুরুষ মানুষের) কন্ঠার উপরে উচু হয়ে দেখা যায় বলে ইংরেজিতে এটি Adam’s Apple নামে পরিচিত। Adam’s Apple এর গল্পটি মুহম্মদ আবদুল হাই- তাঁর ‘ধ্বনিমুঞ্জসা’ গ্রন্থে বলেছেন।
৪. স্বররন্ধ্র (Glottis): স্বরতন্ত্রীর মধ্যবর্তী সৃষ্ট পথটিকে বলে ‘গ্লটিস’। স্বররন্ধ্র দেখতে ত্রিকোণাকৃতির, অনেকটা উল্টো ইংরেজি ‘ভি’ এর মতো।
- স্বররন্ধ্রে বায়ুপ্রবাহ দ্রুত হলে ঘোষ ধ্বনির সৃষ্টি হয়।
- স্বররন্ধ্রে বায়ুপ্রবাহ ধীর গতিতে হলে অঘোষ ধ্বনির সৃষ্টি হয়।
- স্বরতন্ত্রের অনুরণের ফলে হ্রস্ব ও মীড়ের উচ্চতা নির্ভর করে।
৫. অধিজিহ্বা (Epiglottis): বাগধ্বনি উৎপন্নের ক্ষেত্রে এটি প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগে না। মানুষ যখন কোনো কিছু গিলে খায় তখন অধিজিহ্বা প্রতি ঢোকের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে শুয়ে পড়ে শ্বাসনালিকে বন্ধ করে দেয় যাতে কোনো খাদ্যকণা বা তরল ফুটা শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে না পারে। দৈবাৎ কখনো কোনো কিছু ঢুকে গেলে মানুষের বিষম লাগে।
৬. আলজিভ (Uvula): কোমল তালুর পেছনে কলাতন্তুর সাহায্যে তৈরি এবং দেখতে অনেকটা অর্বুদ বা আবের মতো। মনে হয় এক টুকরা মাংসপিণ্ড যেন ঝুলে আছে। ধ্বনি উৎপাদনে আলজীভের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
৭. গলনালীর দেয়াল (Pharynx wall): আপাতত মনে হয় এটি কোনো বাগযন্ত্র বা বাগযন্ত্রের অংশ নয় । কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায় যে, এটি না থাকলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা সম্ভব নয়। ফুসফুসাগত বাতাস স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে পার হয়ে জিহ্বার গোড়ালী এবং গলনালীর দেয়াল দ্বারা তৈরি স্বরপথের মধ্য দিয়েই যায় । এটিকে বাগযন্ত্র বলার আরো বিশেষ কারণ এই যে , গলনালীর দেয়ালের এই স্থান থেকে কোনো ভাষার বিশেষ প্রকার ধ্বনি (যেমন-আরবি ভাষার & th) জাতীয় ধ্বনি Pharynx sound) উৎপন্ন হয়।
৮. স্বরতন্ত্র (Vocal cords): স্বরবন্ধের মধ্যে দুটি সুষম তন্তু আছে। এই তন্ত্র – যুগলকে একসঙ্গে বলা হয় স্বরতন্ত্র।
৯. জিহ্বা (Tongue): বলা হয়ে থাকে জিহ্বাই নাকি প্রধানতম বাগযন্ত্র। হিন্দি-উর্দু ভাষায় সেজন্য জিহ্বাকে বলে “জবান” যার আসল অর্থ ‘কথা’। বাগযন্ত্র হিসেবে জিহ্বার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি না থাকলে সত্যিই মানুষ ‘কথা’ বলতে পারতো না। যাদের জিহ্বার গড়নে জন্মগত ত্রুটি থাকে অথবা কারো যদি কোনো কারণে জিহ্বার সাময়িক অসুবিধা ঘটে (অতিরিক্ত মাদক সেবনে, দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় ) তবে তার কথা বলায় অসুবিধা হয়, কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না।
বাগযন্ত্র হিসেবে জিহ্বার প্রধান চারটি ভাগ।
ক. জিহ্বার গোড়ালী (root of the tongue)
খ. পশ্চাৎ জিহ্বা (back of the tongue)
গ. মধ্য জিহ্বা (mid of the tongue)
ঘ. জিহ্বার অগ্রভাগ (Irony of the tongue)
১০. দাঁত (Teeth): মানুষের দু’পার্টি দাঁতের মধ্যে নিচের পার্টির দাঁত ধ্বনি উচ্চারণে ততটা গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে না, কিন্তু উপরের পাটির দাঁতের গুরুত্ব যথেষ্ট। উপরের সামনের চারটি দাঁত ধ্বনি উচ্চারণে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। বিশেষ করে সামনের মাঝখানের দুটি বড় দাঁতের কার্যকারিতা অপরিসীম। প্রবীণ ব্যক্তি মাসের সামনের দাঁত নাই (অথবা উপরের পাটির আরো কিছু দাঁত পড়ে গিয়েছে) তাঁদের বচন থেকে সহজেই বোঝা যায় সামনের উপরের দাঁতের উচ্চারণ ক্ষেত্রে গুরুত্ব।
১১. তালু (Palate): তালুকে বলা হয় মুখের ছাদ (roof of the mouth)। তালু মুখ্যত দুটি অংশে বিভক্ত:
১. শক্ততালু ও
২. নরমতালু।
১২. ঠোঁট (Lips): ধ্বনি উৎপাদনে ঠোঁঠের গুরুত্ব অপরিসীম। সুকুমার সেন (১৯৯৩: ৩১) অবশ্য দুই ঠোঁটের দুটি স্বতন্ত্র নাম দিয়েছেন। তিনি উপরের ঠোঁটকে বলেছেন ‘ওষ্ঠ’, আর নিচের ঠোঁটকে অভিহিত করেছেন ‘অধর’ বলে। দুই ঠোঁটের মধ্যকার ফাঁকের তারতম্য ভেদে স্বরধ্বনির প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। উচ্চারণস্থান ও উচ্চারণরীতি বিচারেও ঠোঁঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৩. চোয়াল (Jaws): চোয়াল থেকে সরাসরি কোনো ধ্বনি উচ্চারিত হয় না। কিন্তু চোয়ালের গতিশীলতা ছাড়া স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ সম্ভব নয়। তাই বাকপ্রত্যঙ্গ হিসেবে চোয়ালের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৪. নাক (Nose): নাক হল মেরুদণ্ডীর মুখের সামনে থাকা একপ্রকার স্ফীত সংবেদক অঙ্গ। নাকের নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাসক্রিয়ার বায়ু প্রবেশ ও প্রস্থান করে। আর এভাবেই নাক মানবভাষার ধ্বনি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সহায়ক গ্রন্থ
১. জীনাত ইমতিয়াজ আলী: ‘ধ্বনিবিজ্ঞানের ভূমিকা’
২. মহাম্মদ দানীউল হক: ‘ভাষাবিজ্ঞানের কথা’
৩. মুহম্মদ আবদুল হাই: ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’
৪. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’