বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বেকারত্ব, হতাশা, দারিদ্র্য লক্ষ করে এসময়ের তরুণ সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-কল্যাণের জগতের বিপরীতে অনাহারক্লিষ্ট, কুৎসিত, বিপর্যস্ত পৃথিবীকে সাহিত্যে রূপায়িত করেন। একদিকে ইংরেজদের শাসন-অত্যাচার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, সারাবিশ্বে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজস্ব শিল্পসাহিত্যে থমকে থাকা ভাব।
এসময় দীনেশরঞ্জন দাস, মানবেন্দ্রনাথ বসু, গোকুলচন্দ্র নাগ ও সুনীতা সেন মিলে ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ নামে একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করতেন। এই ক্লাবটিতে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও নাটক নিয়ে নিয়মিত আলোচনা ও চর্চা করা হতো। ১৯২২ সালে তাঁরা ‘ঝড়ের দোলা’ নামে একটি ছোটগল্প সংস্করণ বের করেন। ‘ঝড়ের দোলা’র প্রেরণা নিয়েই ১৯২৩ সালে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশচন্দ্র দাস ‘কল্লোল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা গড়ে তোলেন। যদিও মাত্র ৭ বছর (১৯২৩-১৯৩০) পর্যন্ত পত্রিকাটি টিকে ছিল, কিন্তু ধারা পরিবর্তনে পত্রিকাটির প্রভাব অনস্বীকার্য। এসময়ের অন্যান্য সাময়িক পত্রিকা যেগুলো ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে অনুসরণ করে সেগুলো হলো – ‘উত্তরা’ (১৯২৫), ‘প্রগতি’ (১৯২৬) এবং ‘কালিকলম’ (১৯২৬)। ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসময়ের সাহিত্যিক গোষ্ঠীই ‘কল্লোলগোষ্ঠী’ নামে পরিচিত। কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা।
কল্লোল গোষ্ঠীর তিন জন ঔপন্যাসিকের নাম
১. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়;
২. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
৩. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে সময়ে কল্লোলের আবির্ভাব, তখন বাংলা সাহিত্যের সর্বকোণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবে প্রোজ্জ্বল। কল্লোল যুগের লেখকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে এসে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা। রোমান্টিক আবেগের বদলে জীবনসংগ্রামের চিত্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি সহানুভূতি, নরনারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত প্রকাশভঙ্গি, শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ মিলিয়ে যে নিরেট মানুষ, তার জীবনযাপনের স্বরূপ উদঘাটনই কল্লোল যুগের বিশেষ অবদান।
‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়’ খ্যাত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘কল্লোলগোষ্ঠী’র লেখক ছিলেন। তবে সাহিত্যিক মূল্যায়ন ও জীবন দর্শনের বিচারে তাঁরা ‘কল্লোলগোষ্ঠী’র লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।