বনফুল সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন-ভাবনা অনুসারী ছিলেন, উচ্ছলতাকে তিনি মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেন নি। যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে বনফুল আস্থাশীল। যৌবনের উজ্জ্বলতা, উদ্দামতা, সীমালঙ্গন, বিড়ম্বনা, গতিপ্ৰাণতার প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল, কিন্তু যে যৌবনের আচরণ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, সেই অসংযমী যৌবনধর্মকে বনফুল সমর্থন করেননি কোনদিন। তীব্র কশাঘাত হেনেছেন সেই অসংযমী আচরণের প্রতি। যার নিদর্শন মেলে “জৈবিক নিয়ম” গল্পে। | রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে রােগা গােছের একটি উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে যৌবনের সনাতন মনােবৃত্তির তাড়নাতে এমন সব আচরণ করছিল যাতে লেখকের প্রথমে মনে হয়েছে জৈবিক নিয়ম অনুসারে যৌবনের ধর্মই এই। “প্ল্যাটফর্মে সর্বসুদ্ধ জনচারেক যাত্রী ছিল। তার মধ্যে। দু’জন সাঁওতাল, একজন ঐ ছােকরা আর একটি মেয়ে।
ছেলেটি প্ল্যাটফর্মে এমন সব আচরণ করছিল যাতে মেয়েটি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। ট্রেনে মােট বইবার ভাড়া এত বেশী কেন, ট্রেন এত লেট কেন, এনিয়ে এত জোড়ে জোড়ে ছেলেটি কথা বলছিল, যাতে তরুণীর দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ হয়। ছােকরাটি মেয়েটির সামনে খানিকক্ষণ পদচারণা করল। তারপর শিশ দিতে দিতে সােডা ওয়ালাকে ডাকল, সােডাটি এমনভাবে পান করছিল, যে সােডা পান করাটাও যেন একটা বীরত্ব। তারপর চানাচুরওয়ালাকেও অকারণে কটুক্তি করল, যদিও চানাচুর কিছু কিনল। এসব বাহাদুরীর লক্ষ্য ওই তরুণী। বলা বাহুল্য, সেই তরুণীও সেই ছােকরাকে দেখছিল, চোখাচোখিও হতে লাগল। চানাচুর কিনে ছােকরাটি মেয়েটিকে খেতে অনুনয় করল, মেয়েটি লজ্জিত হলেও খেল। কথাবার্তায় মেয়েটি পরের ট্রেনে যাবে জেনে ছােকাটি আবার তার সামনে ‘বুক চিতাইয়া উন্নত মস্তকে অকারণ পুলকে বেশ খানিকক্ষণ পদচারণা করিল। তারপর ছােকরাটি অকারণে গায়ের পেশীগুলাে ফুলােতে লাগল, একটু শিস্ দিল, প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল পারার চেষ্টা করতে লাগল, কিছু ফুল পেরে মেয়েটির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে ট্রেন চলে এসেছে প্ল্যাটফর্মে। ছােকরা গাড়িতে উঠে জিনিসগুলাে ঠিকঠাক রেখে আবার নেমে আসল, তরুণীটির পানে একবার চেয়ে দেখল, “দেখিল তরুণীও তাহার দিকে তাকাইয়া আছে।’ “ট্রেন ধীরে ধীরে চলিতে শুরু করিল। তখনও ছােকরা ট্রেনে উঠে না। ট্রেনের গতিবেগ যখন বেশী বাড়িয়াছে তখন সে শেষ বাহাদুরিটা দেখাইবার জন্য হাস্যমুখে মেয়েটিকে নমস্কার করিয়া চলন্ত ট্রেনে লাফাইয়া উঠিল। কিন্তু তৎক্ষনাৎ পা ফসকাইয়া একেবারে নীচে চাকার নীচে পড়িয়া গেল। আর কিছু করিবার সুযোগ পাইল না।”
ছােকরাটির যাবতীয় বাহাদুরী দেখানাের পেছনে ছিল ঐ মেয়েটি। ছােকরাটি নিজের পৌরুষ প্রতিপন্ন করতে চাইছিল মেয়েটির সামনে। ছােকরাটির অসংযত যৌবনই তাকে এসব করতে যেন অস্থির করে তুলেছিল। তাই বেহিসাবী যৌবন উন্মাদনা তার করুণ পরিণাম ডেকে আনল। বাহুল্য ও আতিশয্যে যৌবনের ধর্মের সহজ প্রকাশ ঘটলেও তার নিয়ন্ত্রণও প্রয়ােজন, নচেৎ তা জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেমনটি ছােকরাটির হয়েছে। বনফুল যৌবনের এই অনিয়ন্ত্রিত উদ্দামতাকে কোন দিনই সমর্থন করেননি। আসলে যে বয়সের ধর্ম তা অনুধাবন ও নিয়ন্ত্রিত করার মত ক্ষমতাও তাদের থাকে না সবার, যাদের থাকে তারা সঠিকপথে জীবনকে পরিচালিত করতে পারে, আর যাদের তা থাকে না তারা ঐ ছোকরার মত পা ফসকাইয়া’ ধ্বংসের মুখে, মৃত্ম মুখে পতিত হয়।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।