Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

নজরুল’ই হচ্ছেন বাংলার প্রথম বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী কবি

সূচনা: আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রথম জনসাধারণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতার ধারায় নজরুলই প্রথম মৌলিক কবিসত্তার পরিচয় দিয়েছেন। ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫) নজরুলের অন্যতম কাব্য। এই কাব্যে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবোধের চরম বিকাশ লক্ষ করা যায়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যে কবি জাতি, ধর্ম, বর্ণের বিভেদ ভুলে সকলকে সমান দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন। “গভীর ঘনিষ্ট মানবতাবোধই নজরুলকে বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে”- যা এ কাব্যের মূল সুর। কাব্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে নারী ও বারাঙ্গনা’দের কবি গুরুত্বের সহিত তুলে ধরেছেন। নিম্নে কীভাবে গভীর ঘনিষ্ট মানবতাবোধ নজরুলকে বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে তা ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের আলোকে আলোচনা করা হলো।

মূলপর্ব: ‘সাম্যবাদী’ কাব্যে এগারটি কবিতা রয়েছে। প্রত্যেক কবিতার মূলসুর মানবতাবাদ, সেই সাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বর্তমান সমাজের প্রতিটি মানুষ অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে প্রস্তুত হন সেই সাথে অপরাধীকে শাস্তি দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তাচেতনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেছেন অপরাধ সৃষ্টির কারণ কি? কেন মানুষ অপরাধ করে? কেন চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বেশ্যাবৃত্তিতে নিযুক্ত হয়? সেই সকল কারণ খুঁজে বের করা এবং তা বন্ধ করা। এ জায়গায়ই নজরুল সবার থেকে আলাদা। কবির উপলব্ধি কেউ চোর, ডাকাত, বারাঙ্গনা, কুলি-মজুর হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পৃথিবীতে আসার পর তাদেরকে এ বিশেষণ দেওয়া হয় অর্থাৎ তা আরোপিত একটা বিষয়। তাই তিনি এ কাব্যের প্রতিটি কবিতায় মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন।

গাহি সাম্যের গান–

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই , নহে কিছু মহীয়ান্! (মানুষ)

কবি বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষবাষ্পের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তো তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, সবাইকে একই কাতারে স্থান দিয়েছেন।

“গাহি সাম্যের গান 

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান 

যেখানে মিশেছে হিন্দু – বৌদ্ধ – মুসলিম – ক্রীশ্চান।” (সাম্যবাদী)

শুধু তাই নয় তিনিই একমাত্র কবি যিনি পৃথিবীর সকল ধর্মকে এক কাতারে স্থান দিয়েছেন-

“কোৱান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক 

জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ।” (সাম্যবাদী)

নজরুল জোর দেন অন্তর ধর্মের ওপর। ধর্মগ্রন্থ পড়ে অর্জিত জ্ঞান যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে প্রয়ােজন মানবিকতাবােধ। এত পুঁথি পড়ার পক্ষপাতী কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন না। তাঁর মতে নিজের হৃদয়কে চিনতে পারলে আর কিছু দরকার হয় না। যা আমরা গ্রন্থ পড়ে অনুধাবন করি তা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়কে প্রশ্ন করলেই উত্তর পেয়ে যাব। সুতরাং গ্রন্থ পড়ে লাভ নেই আগে নিজেকে জানতে হবে।

“এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।” (সাম্যবাদী)

‘কুলি-মজুর’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘নারী’ ইত্যাদি কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। ‘চোর-ডাকাত’ কবিতায় কবি বলেছেন-

“কে বলে তোমায় ডাকাত, বন্ধু কে বলে করিছ চুরি! 

চুরি করিয়াছ টাকা ঘটি বাটি, হৃদয়ে হাননি ছুরি। (চোর-ডাকাত)

কবির মতে একজন মানুষ খেতে না পেলে এক সময় খাবার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য চুরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা ক্ষুধার্তরাই বুঝে ক্ষুধার জ্বালা। চোর তো কারও হৃদয়ে আঘাত করেনি। যা করেছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। তাই কবি চোরকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন।

‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় কবি অত্যন্ত আপন করে বারাঙ্গনাকে মা বলে সম্বোধন করেছেন। বারাঙ্গনা আজ তাকে কে বানিয়েছে। এ সমাজ , সমাজের ঘৃণা মানুষ। কবি সেই সকল মানুষকে ঘৃণা করতে বলেছেন, একজন অসহায় নারীকে নয়।

“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও গায়ে?” (বারাঙ্গনা)

‘নারী’ কবিতায় কবি নারীকে নারী হিসেবে নয় বরং পুরুষের সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন।

“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর 

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” (নারী)

এই কাব্যে কাজী নজরুল ইসলাম বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কবির বিশ্বাস মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা সবচেয়ে সম্মানের। নজরুলের এ আদর্শ আজও প্রতিটি মানুষের জীবনপথের প্রেরণা। কিন্তু মানুষ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে রাজনীতি করে, দুর্বলকে শােষণ করে, এখনও একের বিরুদ্ধে অন্যকে উস্কে দেয়। এক জনের প্রতি অন্য জনকে বিমুখ করার ষড়যন্ত্র করে। নজরুল এ কবিতায় বলেছেন- 

“মানুষেরই মাঝে স্বৰ্গনরক মানুষেতে সুরাসুর।”

নজরুল জোর দেন অন্তর ধর্মের ওপর। ধর্মগ্রন্থ পড়ে অর্জিত জ্ঞান যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে প্রয়ােজন মানবিকতাবােধ। কবি বলেছেন মানুষের হৃদয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন মন্দির কাবা নেই। কবি সকল মত, সকল পথের উপরে স্থান দিয়েছেন মানবিকতা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম সকলকে একই মায়ের সন্তানের মতাে ভেবেছেন। নজরুল মানবিক মেলবন্ধনের জন্য সংগীত রচনা করেছেন। বাণী ও সুরের মাধ্যমে মানবতার সুবাস ছড়ানাের চেষ্টা করেছেন। নজরুল ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতাে পবিত্র মনে করেছেন মানুষের হৃদয়কে। এ হৃদয় যদি পবিত্র থাকে, হৃদয়ে যদি কারাে প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ না থাকে, সকলের প্রতি সমদর্শিতা থাকে তাহলে পৃথিবী হবে সুখের আবাসস্থল। সাম্যবাদ মানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বিৰ্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত এ মতবাদ। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাম্যবাদী’ কবিতায় সব ধরনের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাম্যবাদের বাণী প্রচার করেছেন।

যবনিকা:  নারী পুরুষ ভেদাভেদ নজরুল মেনে নেননি। তাঁর কাছে প্রত্যেকের পরিচয় মানুষ হিসেবে। তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করার চেষ্টা করেছেন তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যে । বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে, সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ছাড়পত্র’ কাব্য প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার দিয়ে সাম্যবাদী সমাজ গঠনের বাণী উচ্চারণ করেছেন । কবি উপনিবেশিত সমাজে বসবাস করে নিম্নেশ্রেণির মানুষের যে দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখেছেন এবং সেই নিম্নশ্রেণির মানুষের সব রকম মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। কবি নজরুল সমাজ থেকে যত অন্যায় অবিচার , শোষণ নির্যাতন যা কিছু আছে সব কিছুকে দূর করে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে লেখনী ধারণ করেছিলেন। তাঁর সেই ব্রত অনেক কাব্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ‘সাম্যবাদী’ কাব্য গ্রন্থটিও এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ কবির জীবনবোধ বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ এবং ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের বিষয় উভয়ই যেন একসূত্রে গাঁথা।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান কয়টি ও কী কী? ছোটগল্পের গঠন কৌশল ও প্রকারভেদ আলোচনা করো

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান কয়টি ও কী কী? ছোটগল্পের গঠন কৌশল ও প্রকারভেদ আলোচনা করো

গল্প আর ছোটগল্প এক নয়। গল্প হল বর্ণিত আখ্যান। কিন্তু ছোটগল্পে আখ্যানকে বিশেষ রীতি, শৈলী ও রূপে প্রকাশ করা হয়। সাহিত্য-শিল্পের মধ্যে ছোটগল্প হল সর্বাধুনিক।

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য অষ্টম সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য অষ্টম সর্গ ব্যাখ্যা

অষ্টম সর্গের নাম প্রেতপুরী। লক্ষ্মণের দুর্দশায় শােকে মর্মাহত রামচন্দ্রের করুন অবস্থা দেখে দেবী পার্বতী অত্যন্ত দুঃখ বােধ করলেন। মহাদেব পার্বতীর দুঃখের কারণ জেনে প্রতিকারের উপায়

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য নবম সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য নবম সর্গ ব্যাখ্যা

নবম সর্গের মূল ঘটনা মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে “সংস্ক্রিয়া’ একদিকে রামচন্দ্রের শিবিরে উল্লাস আনন্দের উচ্ছ্বাস এবং অপরদিকে লঙ্কাপুরীতে হতাশা ও শােকের প্রকাশ

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদবধ। দৈবাস্ত্র লাভ করবার পর লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের কাছে সেটি কীভাবে পেলেন তা বর্ণনা করে। তিনি জানান লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.