Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর

নামকরণ একটি শিল্প। কাব্যের বিষয়বস্তু, ভাবসম্ভার, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কবির উপলব্ধি-জাত চিন্তাচেতনার যে প্রকাশ তাই এ কাব্যের নামকরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্য বয়ে এনেছে। তবে সংক্ষিপ্ত অথচ শ্রুতিমধুর নামকরনের মধ্যে কাব্যের অধিকাংশ কবিতার যদি প্রতিফলন থাকে তাহলেই নামকরণ সার্থক হয়।
জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে একথা সর্বজনস্বীকৃত। জীবনের ভিত্তি যখন নড়ে যায়, যখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আঘাতে জীবনের প্রাচীন অর্থ ও আদর্শ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, জীবনাকাশে যখন বিচিত্র রঙ্গের রােমান্স ঢেউ তােলে তখন শিল্পের ও রূপান্তর ঘটতে বাধ্য। জীবনের গতিবেগের সঙ্গে সাহিত্য তখন স্বচ্ছন্দে মিলিত হয়ে যায়। নজরুলের সাহিত্য কর্মে জীবনের এই গতিবেগের মিলিত রূপ দেখতে পাই। নজরুল যখন বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশে প্রথম মহাযুদ্ধের অভিন্নতা নিয়ে এলেন তখন একদিকে সমগ্র বাংলায় তথা ভারতবর্ষে এক বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, বুদ্ধিজীবীদের উপর সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেপ, জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র নরনারীর রক্তে রক্তাক্ত রাজপথ, যুদ্ধের ফলে দুনিয়াজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা প্রভৃতির চাপে মধ্যবিত্ত সমাজের সাজানাে বাগানে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। রুশ বিপ্লব এবং তৎকালীন ইউরােপের ব্যক্তিস্বার্থ শ্রেণীবাদী লেখকদের প্রভাবে পুরানাে আমলের ধ্যান-ধারণার বুনিয়াদ অবিশ্বাসের তীব্র আঘাত, মৃত্যু, দুঃখ, বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাক্ত অরুণােদয় আসন্ন। সংকটাপন্ন বুদ্ধিবাদ তখন পথ খুঁজছে নতুন দিকে, নতুন বাস্তব অবস্থাকে আত্মসাৎ করবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ফিরছিল। নজরুল এ অবস্থায় তার অগ্নি-বীণা হাতে নিয়ে বিদ্রোহী বেশে বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভূত হলেন। রবীন্দ্র বিরােধিতার ক্ষেত্রে প্রথম বলিষ্ঠ কণ্ঠ তারই। জনজীবনের সঙ্গে কাব্যকে সার্থকভাবে যুক্ত করার প্রথম গেীরব বহুলাংশে তিনিই দাবি করতে পারেন। বাংলা কাব্যের বিদ্রোহ, পেীরুষ ও যৌবনের অগ্রগণ্য ভাষ্যকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
নজরুলের আবির্ভাব তাই একটা আকস্মিক ঘটনা নয়, তিনি যুগমানসের প্রতীক। সমকালীন যুগের মানস-সস্তান। নজরুলের বিদ্রোহের এমন একটা স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা সকল সুর, সকল কণ্ঠ অতিক্রম করে আমাদের কর্ণগােচর হয়েছে।
নজরুল মানুষের কবি ছিলেন। মানুষ ও মানবতাই তার জীবনমন্ত্র ছিল। এদেশের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অসহায়, অত্যাচারিত, শােষিত জনগণের মূঢ় হৃদয়ের কথা তিনি এ কাব্যে বিষয়বস্তু করেছেন। মুসলমান হয়েও তিনি নিজেকে ধর্মবর্ণ গােত্রের কোনাে সংকীর্ণ গন্ডিতে বেঁধে রাখেননি। তিনি আজীবন হিন্দু মুসলমানের ক্ষুদ্র মুখােশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন মানবাত্মার সন্ধান করেছেন এ কাব্যে তিনি তারই জয়গান করেছেন। সমাজের কুটি এবং লাঞ্ছনা, সরকারি স্বৈরাচার এবং কারাগারের বন্দী জীবনও নজরুলকে সত্য সাধনার পথ থেকে বিচলিত করতে পারেনি। প্রচলিত কোনাে বিশেষ মতে বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে তিনি নিয়ম ও প্রথার গন্ডিকে ভেছে সত্যাসত্য ও সুন্দরের আহ্বানে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মনুষ্যত্বের পূজারী কবি একদিকে এ কাব্যে মানবতার বেদনাকেই ভাষা ও ছন্দে রূপায়িত করেছেন একদিকে, অপরদিকে জাতিভেদের উর্ধ্বে উঠে এ কবির বুকে বাঙালি জাতির প্রতি অপমান অব্যক্ত বেদনার ভারে ফেনিয়ে উঠেছে। এজন্যেই তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে সেদিন এই নৰকাব্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পেরেছেন।
১৩৩১ বঙ্গাব্দের (১৯২৪) শ্রাবণ মাসের ‘বঙ্গবাণী’তে অগ্নি-বীণার নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়, “কবিতাগুচ্ছের অগ্নি-বীণা নাম সার্থক হয়েছে; কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে আগুনের ফুলকি ছুটিয়াছে, আর কোথাও না সে আগুন দাউ দাউ করিয়া জুলিয়াছে।”
তখনকার দিনের অন্যতম অভিজাত মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে এই গ্রন্থটি সম্পর্কে বলা হয়, “গ্রন্থখানির সব কবিতাগুলিই অগ্নিগর্ভ, উদ্দীপনাময়। যে যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়াইয়া ভারতবর্ষ আজ আপনার ভাগ্য গড়িয়া তুলিতে চাহিতেছে সেই যুগ-নির্মাতা রুদ্র-দেবতার আগমনধ্বনি গ্রন্থখানিতে শুনতে পাওয়া যায়।” 
মুসলমান সমাজের এক রক্ষণশীল অংশ অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁদের কাছে নজরুল ইসলাম ধর্মের শত্রু ও তৌহীদের মূল উৎপাটন করে পৌত্তলিকতা-প্রতিষ্ঠায় তৎপর। অর্থাৎ বিদ্রোহী কবিতাটির জন্যে নজরুলের উপর অজস্র ব্যঙ্গপি বর্ষিত হয়। কিন্তু এইসব ব্যঙ্গপি নজরুলের পক্ষে শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। এ কাব্যে কবির বিদ্রোহে রাজনীতির ও সমাজনীতিক চেতনার স্বাক্ষর থাকলেও তা মূলত রােমান্টিক। প্রকৃত অর্থে এ কাব্য বিদ্রোহ ৰাণীর বাহক নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে এক অপূর্ব উন্মাদনা- এক অভূতপূর্ব আত্মবােধ, সেই আত্মবােধের প্রচণ্ডতায় ও ব্যপকথায় কবি দিশেহারা। এ কারণেই এ কালে অগ্নি থাকলেও সে অগ্নি-বীণায় পরিণত হয়েছে। ফলে নামকরণটি বিষয়ানুগ ও সার্থক হয়েছে।
নজরুলের জীবন গতানুগতিক পথ ধরে চলেনি। তাই তাঁর সৃষ্টিও বৈচিত্র্যে ভরে উঠেছিল। তিনি বাঙলার কোমলকান্ত ও নিস্তেজম্লান জীবনে নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে তাকে বৃহত্তর মুক্ত জীবনের ডাক শুনিয়েছিলেন। জনজাগরণের এই মহৎকাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন বলেই মহাকালের কাছে অমরতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘অগ্নি-বীণা’ তাই নামকরন তাৎপর্যে সার্থক ও সফল।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান কয়টি ও কী কী? ছোটগল্পের গঠন কৌশল ও প্রকারভেদ আলোচনা করো

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান কয়টি ও কী কী? ছোটগল্পের গঠন কৌশল ও প্রকারভেদ আলোচনা করো

গল্প আর ছোটগল্প এক নয়। গল্প হল বর্ণিত আখ্যান। কিন্তু ছোটগল্পে আখ্যানকে বিশেষ রীতি, শৈলী ও রূপে প্রকাশ করা হয়। সাহিত্য-শিল্পের মধ্যে ছোটগল্প হল সর্বাধুনিক।

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য অষ্টম সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য অষ্টম সর্গ ব্যাখ্যা

অষ্টম সর্গের নাম প্রেতপুরী। লক্ষ্মণের দুর্দশায় শােকে মর্মাহত রামচন্দ্রের করুন অবস্থা দেখে দেবী পার্বতী অত্যন্ত দুঃখ বােধ করলেন। মহাদেব পার্বতীর দুঃখের কারণ জেনে প্রতিকারের উপায়

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য নবম সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য নবম সর্গ ব্যাখ্যা

নবম সর্গের মূল ঘটনা মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে “সংস্ক্রিয়া’ একদিকে রামচন্দ্রের শিবিরে উল্লাস আনন্দের উচ্ছ্বাস এবং অপরদিকে লঙ্কাপুরীতে হতাশা ও শােকের প্রকাশ

Read More
মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদবধ। দৈবাস্ত্র লাভ করবার পর লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের কাছে সেটি কীভাবে পেলেন তা বর্ণনা করে। তিনি জানান লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.