Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থের – রিভিউ, বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা এবং সারমর্ম

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি বই-এর লেখক, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস৷ বইটি মোট ১১টি অধ্যায়ে লেখা। এই বইতে এঙ্গেলস – মরগান, মমসেন, ম্যাক-লেলান, স্কট ইত্যাদি লেখকের করে যাওয়া কাজ ও মার্ক্স এর কিছু লেখার থেকে সাহায্য নিয়েছেন, তবে যেখানে প্রথমোক্ত লেখকদের সাথে মার্ক্সের বক্তব্য মেলেনি, সেখানে তিনি মার্ক্সকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক একটি রচনা হচ্ছে ফ্রিডরিখ এর “পরিবার , ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”৷

ইংরেজিতে : The Origin of the Family , Private Property , and the State : in the Light of the Researches of Lewis H. Morgan.

পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রকে ধনতান্ত্রিক সমাজের সমাজবিজ্ঞানীগণ মানুষের জীবনের অপরিহার্য এবং চিরন্তন সংস্থা বলে প্রচার করে আসছিল । মার্কসবাদ সর্বপ্রথম সমাজের এরূপ ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে । সমাজের বিকাশের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার প্রকাশ ঘটেছে এঙ্গেলসের বর্তমান পুস্তকে ।

আমেরিকার বস্তুবাদী সমাজবিজ্ঞানী লিউস হেনরী মর্গানও তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ প্রাচীন সমাজ ’ – এ মানুষের আদি অবস্থা থেকে তার সংগঠনগত বিকাশের পর্যায়সমূহকে প্রচুর তথ্য সহকারে তুলে ধরেছিলেন । উক্ত তথ্যসমূহের উপর ভিত্তি করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানের অপরাপর গবেষণার সাহায্যে এঙ্গেলস তাঁর এই গ্রন্থে প্রথমে মানুষের আদিম সাম্যবাদী অবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেছেন । এঙ্গেলসের এই রচনায় মানবজাতির বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়গুলােতে মানবজাতির ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে ; আদি গােষ্ঠীগত সমাজের পতনের প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত মালিকানার উপর স্থাপিত শ্রেণীগত সমাজের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে ; এই সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখানাে হয়েছে ; ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পারিবারিক সম্পর্কের বিকাশের বিশেষত্ব ব্যাখ্যাত হয়েছে ; রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও সারমর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে এবং শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজের চড়ান্ত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রের বিলােপের ঐতিহাসিক অনিবার্যতা প্রতিপন্ন করা হয়েছে ।

এতে মূল বক্তব্য ছিল, আদিম যুগ থেকে সভ্যতায় পদার্পণের ফলে মানব সমাজ ও জীবন যাপন ধারায় কাঠামোগত পরিবর্তনের উপর জ্ঞান ও শিল্পের প্রসার, পুঁজির আবিষ্কার, পুঁজির বিকাশের প্রভাব নিরূপণ।

এখানে আদিম মানব সমাজের নমুনা হিসাবে মার্কিন লাল চামড়ার ইরকোয়াসদের উল্লেখ করা হয়েছে। বর্বর যুগের উদাহরণ হিসাবে  গ্রীক, কেলটিক ও জার্মানদের উল্লেখ করা হয়েছে এবং সভ্য হিসাবে এথেনীয় ও রোমানদের দেখানো হয়েছে। এছাড়াও ইউরোপ ও এশিয়াতে বসবাসকারী আর্য্য ও সেমেটিক জাতির সম্পর্কে সামান্য বর্ণনা দিয়েছেন।

মরগানের মতে মানব সমাজের তিনটি স্তর আছে৷ যথা :

১. বন্য,

২. বর্বর ও

৩. সভ্য।

লেখক তা মেনে নিয়ে উপরোল্লেখিত জাতিদের মধ্য এই তিন স্তরের সমাজ ব্যবস্থা ও জীবন যাপনের তরিকা এবং এর পারষ্পরিক তুলনা করেছেন।

লেখক দেখিয়েছেন যে, বন্য পর্যায়ে মানুষের পরিবার কেন্দ্রিক সরল জীবনে ছিল নারী- পুরুষের মধ্য সমতা, সম্পদ বণ্টনের মধ্যে ছিল মানবিকতা ও একরকমের গণতান্ত্রিক চর্চা।

কিন্তু বর্বর যুগে এসে –

  1. পুরনো পরিবার প্রথার পরিবর্তন;
  2. বহু নারী ও বহু পুরুষের মাঝে বিবাহ বা জোড়বাঁধা পরিবার; এবং
  3. নতুন পরিবার প্রথার প্রচলন;
  4. এক পতি-পত্নীকেন্দ্রিক পরিবার;
  5. হালকা কাঠ ও পাথরের অস্ত্রের পরিবর্তে ধাতুর ধারলো অস্ত্রের আবিষ্কার,
  6. কৃষি কাজ ও পশু পালন, প্রাচীন জীবন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে।

যার প্রথম শিকার হয় সমাজের নারীরা। নারীরা সম্পদের উপর থেকে অধিকার হারায় ও ক্রমেই ক্ষমতাহীন হয়ে পরে। একপর্যায়ে স্বামীর পূর্ণ অধিকার ও আওতাধীন হয়ে পরে।

সভ্য সমাজে এসে মানবজাতি অর্থ আবিষ্কার করে, ধাতব মুদ্রা, বানিজ্যের প্রসার, শিল্পের বিকাশ শ্রমবিভাজনের সৃষ্টি করে, দাস প্রথার ব্যাপক প্রসার এক অমানবিক জীবনের চিত্রই অংকন করে এখানে। সভ্য সমাজে শ্রেনীর উদ্ভব ঘটে; অভিজাত শ্রেনীর শোষণ ও শাসনের শিকার হয় কৃষক ও দাশ।

লেখক এখানে সভ্যতার দুটি বৈশিষ্টের উল্লেখ করেছেন:

ক. সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, যা মুলত শোষকের রাষ্ট্র, উৎপাদনের মূল দাস-শ্রম, মধ্যস্ততাকারী বা বণিকের আবির্ভাব, অর্থনৈতিক একক হিসাবে এক পতি-পত্নী পরিবার, নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব স্থাপন এবং যাবতীয় দাবীর বিপরীতে অভিজাতদের রক্ষা ও নিপীড়িতদের দমনে রাষ্ট্রকে ব্যবহার;

খ. শহর ও গ্রামের পার্থক্য, শ্রম বিভাজন ও উইলের মাধ্যমে কাউকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা বা কাউকে সম্পদের অধিকার দেয়ার ক্ষমতা।

এই গ্রন্থের ১৮৮৪ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস তাঁর এই গ্রন্থ লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানান যে , “ মর্গান তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে আমেরিকায় ইতিহাসের সেই একই বস্তুবাদী ধারণা পুনরাবিষ্কার করেন , যা মার্কস চল্লিশ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন , এবং বর্বরতা ও সভ্যতার তুলনামূলক বিচারে ঐ ধারণা থেকে তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে মার্কসেরই সমসিদ্ধান্তে পৌঁছান ৷

মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার বিবাহ এবং পারিবারিক বন্ধনের রীতি প্রকৃতিও যে বিবর্তিত হয়েছে , সে তথ্য এঙ্গেলস এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন । প্রাচীন গ্রিক , রােমান এবং টিউটন সমাজের পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত দ্বারা এঙ্গেলস প্রাচীন গােত্রতান্ত্রিক সমাজের ক্ষয়ের ধারাকে বিশ্লেষণ করেছেন । মানুষের শ্রমের উৎপাদনী ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রম বিভাগের মধ্য দিয়ে সমাজে দ্রব্যের বিনিময় প্রথা এবং তার পরিণামে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে ।

এই বিবর্তনে কৌম সমাজের ক্ষয় ঘটে এবং অর্থনীতিক শ্রেণীরও সৃষ্টি হয় । সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদনের বিকাশে যখন পরস্পর বিরােধী স্বার্থসম্পন্ন আর্থনীতিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে , তখনি শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে আবশ্যক হয়েছে বিধিবিধান প্রণয়নকারী ও রক্ষাকারী এক সংস্থার । এই সংস্থার নাম রাষ্ট্র ।

এঙ্গেলস এই গ্রন্থে মােট তিনটি সিদ্ধান্ত টেনেছেন । তাঁর মতে : ১ . পরিবার , ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্র – এগুলি মানুষের সমাজে কোনাে চিরন্তন সংস্থা নয় । অর্থনীতির বিকাশের একটা পর্যায়ে এই সমস্ত সংস্থার উদ্ভব ঘটেছে ।

২. রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রভু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হওয়া । দ্বন্দ্বমান সমাজে প্রভু শ্রেণীর প্রয়ােজন জোর  স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হওয়া । দ্বন্দ্বমান সমাজে প্রভু শ্রেণীর প্রয়ােজন জোর জবরদস্তির মারফত শােষিত শ্ৰেণীকে দমিত করে রাখা । রাষ্ট্রের আইন এবং পুলিশ , বিচার ব্যবস্থা – অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামাে হচ্ছে সেই জবরদস্তি কার্যকর করার মাধ্যম বা যন্ত্র ।

৩. সমাজ অনড় এবং অপরিবর্তনীয় নয় । সমাজের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে । শােষক এবং শােষিত হিসাবে মানুষের শ্রেণীবিভাগ ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও তা অবিনশ্বর নয় । সমাজের বিকাশের পরিণামে একদিন শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে । একদিন যেমন তার উদ্ভব ঘটেছিল , তেমনি আর একদিন তার বিলােপ ঘটবে । সমাজ আবার শােষক শােষিত শ্ৰেণীমুক্ত সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হবে । সেদিন শােষকশ্রেণী থাকবে না এবং তার স্বার্থরক্ষার জন্য কোনাে অত্যাচারমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন থাকবে না । আর তাই সেদিন রাষ্ট্রও অপ্রয়ােজনীয় হয়ে উঠবে । আস্তে আস্তে অত্যাচারমূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷

পরিশেষে লেখক এ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে:

ক. সভ্যতায় পদার্পণ এবং অগ্রসর হবার মূল চালিকা শক্তি মানব জাতির নগ্ন লালসা, সম্পদের লোভ, ক্ষমতার লোভ ও বিলাসের লোভ; এবং

খ. যেহেতু উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পারিবারিক সম্পর্কের মুলে রয়েছে শোষণ তাই এই সভ্যতা দ্বান্দিক ও প্রতি নতুন পদক্ষেপে দ্বন্দে জড়িত পক্ষসমূহের থেকে প্রতিরোধ আসে।

তিনি সমাপ্তি টানতে মরগানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলেছেন; মানব সমাজ, সরকার ব্যবস্থা, রাষ্ট্র জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে, সাম্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে, প্রাচীন সমাজের মাঝে বিদ্যমান স্বাধীনতা, ভাতৃত্ব, মনুষ্যত্ব আবার আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে পবিত্র করে তুলবে। এবং তা হবে ন্যায় সংগত, প্রাচীন জীবনধারার উচ্চতর পর্যায়ে প্রকাশিত প্রতিরূপ।

তথ্যসূত্র :

১. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস,”পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”

২. সরদার ফজলুল করিম ; দর্শনকোষ , প্যাপিরাস , ঢাকা ; জুলাই , ২০০৬ ; পৃষ্ঠা ৩০০ ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.