বাংলা সাহিত্যে নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেও বাংলা নাটকের অন্যতম রূপকার ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র(১৮২১-৭৩)। বাংলা সাহিত্যে কবিতা-গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি নাটকও মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি সময় দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছেন। ভারতীয় বাঙালী এই কবি ও নাট্যকার ব্রিটিশের নাগরিকত্বও লাভ করেন। তিনি রায়বাহাদুর পুরস্কারে ভূষিত হন। দীনবন্ধু মিত্র সেই বাস্তবতার চিত্রপট নিয়েই নাটক রচনা করেছেন, যা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে প্রশংসার শিখরে। দরদী মানুষের মুখের কথা তো লেখকই তুলে আনবেন, এটাই সমাজের প্রত্যাশা। সমাজের প্রত্যাশা পূরণ হলে সমাজ তাঁকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে বুকের ভেতর খোদাই করে রাখে। তেমনি একটি সাহিত্যকর্ম ‘নীলদর্পণ’। ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) বেনামীতে মুদ্রিত দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম নাটক।নাটকটির নাম ছিল ‘নীলদর্পণম নাটকম’ এবং বিজ্ঞপ্তিটি ছিল : ‘নীলকর-বিষধর-দংশনকাতর-প্রজা নিকর-ক্ষেমস্করেণ কেনাচৎ পথিকেনাভি প্রণীতম’। নাটকে নাট্যকারের নাম ছিল না। অনুমান করা হয় এটি ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন এবং অনুবাদের প্রকাশক হিসেবে নাম থাকায় পাদ্রী রেভারেন্ড লং রাজদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।
এই দর্পণে যারামুখ দেখবন তারা ইংরেজ , বিজাতীয় । এদেশের তারা কেউ নয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই কারণেই নাটকটি অনুবাদ করা হয় । তবে যাই হোক এই বিদেশী দুই ধরনের- অত্যাচারী , দুবৃত্ত নীলকর সাহেবরা আর দ্বিতীয় শ্রেণী মানবতাবাদী ভালো ইংরেজরা। এই ভালো ইংরেজদেরকেই এ দর্পণ সমর্পণ করেছেন নাট্যকার । সে কারনে অত্যাচারে র নিখুঁত চিত্র চাই । সেই চিত্র ; প্রতিবিম্ব দেখে যেন তারা নিজেরাই লজ্জিত হয় । তাদের শুভবোধ জাগ্রত হয় । এটিই ছিল নাট্যকারের মূল এ ছাড়া নাটকে উল্লিখিত প্রজাদের সংলাপ থেকে বোঝা যায় , নীলচাষের সম্পূর্ন বিলুপ্তি নয় , প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার বন্ধ করাই নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ।
সেই কারণে দীনবন্ধু চরিত্রদের মুখ দিয়ে বারে বারে বলিয়েছেন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা প্রজারাই যদি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় , তাহলে নীলচাষ করবে কারা । অতএব , ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থেই প্রজাপীড়ন বন্ধ করুক , এমনই বার্তা কৌশলে নাট্যকার দেন।
নাটকটির উল্লেখযোগ্য চরিত্র সমূহ হলো গোলক বসু,নবীনমাধব,রাইচরণ,তোরাপ,সাবিত্রী,সরলতা,ক্ষেত্রমণি ইত্যাদি। নিম্নে আমরা সমাজবাস্তবধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের মূল্যায়ন করব :
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ এ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। নাটকটিতে নাট্যকারের প্রত্যক্ষ স্বজাতি-প্রেম এবং বিদেশি শাসকের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।প্রাচীন সময় থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার মাটিতে নীলচাষের সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন দ্রাবিড়দের মাঝেও নীলের ব্যবহার হতো। দ্রাবিড়রা সিন্ধু নদের তীরে বসবাস করত। প্রচলিত তথ্যমতে, এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয়। ফরাসী বণিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যের সুবাদে বিভিন্ন বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। ১৭৭৭ সালে লুই বন্ড নামের একজন ফরাসী বণিক আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এদেশে নীলচাষ ও নীল ব্যবহারের সূত্রপাত ঘটায়।
পরবর্তীতে বেশি মুনাফার আশায় বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ নীলের কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্যে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রখাতে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এর কারণে নীলের চাহিদাও বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় নীলব্যবসা মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু নীলচাষের ফলে এদেশের মানুষের বেশ অসুবিধাও সৃষ্টি হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অনেক হিন্দু সরকারী কর্মচারীকে জমির মালিক করে দেন। ইংরেজরা এই ভূস্বামীদেরকে তাদের নীল ব্যবসা প্রসারের পথে বাধা হিসেবে আখ্যায়িত করল। কেননা, জমিদারদের অধীনস্ত প্রজাকে দিয়ে নীলকররা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করাতে পারত না। ফলে নীল উৎপাদনে তারা হতাশার ছায়া দেখতে শুরু করে।
ব্রিটিশরা ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন পাশ করে। ব্রিটিশ প্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। তবুও তাদের সমস্যার সমাধান ঘটে না। কারণ জমিদারকে অধিকহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত। বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত। কিন্তু এই খরচ ছিল তাদের জন্য ব্যয়বহুল। তারা চিন্তা করল, দূরবর্তী স্থান থেকে শ্রমিক আনলে খরচ তুলনামূলক কম হবে। কিন্তু সেটিও আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তীতে, ইংরেজরা চৌকস বুদ্ধির পরিচয় দেয়। ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইন বলবৎ করে। যাতে বলা হয়, এই আইনের দ্বারা এদেশে ইংরেজরা জমি ও জমিদারী ক্রয়ের সুযোগ পাবে। ফলে, অনেক জমিদার অধিক মূল্যের আশায় জমিদারী বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়।
অন্যদিকে, অনেকে নীলকরদের বর্বরতার শিকার হয়েও জমিদারী হারায়। এভাবে ইংরেজগণ ধীরে ধীরে বাংলায় জেঁকে বসতে থাকে। তাদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য নীলচাষের এলাকা বর্ধিত করে। যার কারণে কৃষকেরা তাদের উর্বর জমিতে শস্যের বদলে নীল বুনতে বাধ্য হয়। শুরু হয় কৃষকদের ওপর নীলকরদের অমানবিক অত্যাচার। কৃষকেরা নীল ব্যতীত অন্য শস্য উৎপাদন করতে পারত না। নীলকরদের কথা অনুযায়ী কাজ না করলে কৃষকের ওপর চালানো হতো অত্যাচার। ধীরে ধীরে নীলকররা বেশ শক্তিশালী ও বর্বর হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলে তাদের বসতভিটায়ও নীলচাষ করা হতো। আগুনেও পুড়ে দেওয়া হতো কারও ঘর-সংসার। কিন্তু অত্যাচারের পরিধি এত বেশি হয়ে উঠেছিল যে, কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করল। এক সময় চাষীদের এই আন্দোলন বিদ্রোহে রূপান্তর লাভ করে। নীলচাষের বিরুদ্ধে শুরু হলো নীল বিদ্রোহ। নীলচাষীরা তাদের মৌলিক অধিকার ও নীলচাষ-আইন ব্যাহত করার জন্য নীল ব্যবসায়ী ও নীলকরদের বিপক্ষে প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলে। নির্মম নিপীড়ন চাষীদেরকে বিষিয়ে তুলেছিল।
১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নীলচাষীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নীলচাষের অস্বীকৃতি জানায়। তৎকালীন দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট সংবাদপত্রে এই অত্যাচারের কথা তুলে ধরা হয়। জেনে যায় বিশ্বের দরোজা থেকে দরোজা। ভারতের নদীয়ায় (বাংলাদেশের যশোর জেলার চৌগাছা) সর্বপ্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়।
নীলদর্পণ নাটকে নবীনমাধবের নেতৃত্বে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে চিত্র অঙ্কিত তার সাথে কৃষ্ণনগরের নিকটস্থ চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের সংঘবদ্ধ সংগ্রামের সাযুজ্য লক্ষণীয় । বিষ্ণুচরণ একজন ছোট জোতদার ও দিগম্বর একজন ছোট মহাজন ছিলেন । নীলকরদের অত্যাচারের ফলে ক্রমশ তারা কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় । নীল দর্পণ নাটকের লাঞ্ছিতা ক্ষেত্রমণির প্রসঙ্গটি এসেছে নদীয়ার এক কৃষক পরিবারের সুন্দরী কন্যা হরমণিকে হরণ করার প্রসঙ্গ থেকে । কেবল নদীয়ার জেলেই ৮৮৯ জন নীলচাষী নিক্ষিপ্ত হয়েছিল একাদশ আইনের ৫ নম্বর ধারায় । ‘নীল দর্পণ’ নাটকের গোলকবসুর কারাগারে নিক্ষেপ করার ঘটনা । তারই ইঙ্গিত দেয় । এ সময় নীলচাষীরা নানারকম ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আত্মসম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল । তাই তারা দলে দলে জেলে গিয়েছে বা আত্মগোপন করে থেকেছে কিন্তু নীলচাষ করতে রাজি হয় নি । চাষীদের এই দৃঢ় সংকল্পের কারণে সরকার বাধ্য হয়েই ১৮৬৮ সালে অষ্টম আইনের দ্বারা নীলচুক্তির নিয়ম বাতিল করে দেয়। পরে বিদ্রোহটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এরই ধারাবাহিকতায় নীলকরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং ফাঁসিও দেওয়া হয়। কৃষকেরা নীলকরদের প্রতিহত করার জন্য প্রাণপণ লড়ে যায়। একপর্যায়ে নীলকরদের দমন করা সম্ভবপর হয়।
ঐতিহাসিক যোগেশ চন্দ্র বাগল বলেন, ‘কৃষকদের নীল বিদ্রোহের অহিংস আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহের চেয়ে বেশি সফল হয়।’ নীল বিদ্রোহ রোধ করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে চাষীরা তাদের ন্যায্যতা ফিরে পায়। ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে, ১৮৯৫ সালে নীলকরেরা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। নীলকরদের এই অমানবিক অত্যাচারের অধ্যায় নাটকের মাধ্যমে তুলে আনেন দীনবন্ধু মিত্র।নাটকটির ইংরেজী অনুবাদটি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নীলদর্পণ। অনুবাদটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কারাদন্ড ও জরিমানা করা হয় জেমস লঙকে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার একটি বর্বর অধ্যায়ের যে সূত্রপাত ঘটেছিল তা অনেকাংশে সত্যতার হাতেখড়ি- নীলদর্পণ।
এই নাটকটি দীনবন্ধু মিত্রকে খ্যাতি ও সম্মানের চূড়াতে পৌঁছে দিলেও বাঙালী হৃদয়ে একটি নীলদাগ কেটে থাকে, যা কোনদিন মুছে যাওয়ার নয়। স্বদেশ চেতনার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই নাটকটি। সে সময়কার বাংলা সাহিত্য ও সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও সমাদৃত হয়। বাঙালীর মনে এর মমত্ববোধ ও দেশপ্রেমের ক্ষেত্রটা আরও বেশি মজবুত হয়েছিল। তৃণমূলধারার মানুষের মুখের কথা তুলে ধরে বিশ্বদরোজায় বিবেকের কড়া নেড়েছেন লেখক তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে। যেটি মানুষের ভিতরের অব্যক্ত কথা প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। বর্তমান সমকালীন লেখকগণ বোধ করেন, নীলদর্পণ শুধু সেই সময়ের নাটক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেনি, বরং এই সময়েও নীলদর্পণ এর মতো নাটক আমাদেরকে সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দরোজায় কড়া নাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কেননা, সাহিত্যের শিকড়কে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম এগিয়ে যায় সময়ের দাবি মেটাতে। আর সেই দাবি যদি লেখক হিসেবে পূরণ করা সম্ভব না হয় তবে সাহিত্য কিংবা সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল। সুতরাং লেখককে আরও বেশি সজাগ হতে হবে সময় কি দাবি করছে?
বাঙালীর সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে কি ধরনের পরিপূরক প্রয়োজন তা লেখকদেরও খুঁজে বের করার প্রয়োজন আছে বলে বোধ করি। যে কারণেই দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সমকালীন প্রেক্ষাপট নিয়েই সময়ের দাবি পূরণ করেছেন। নীলদর্পণ বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়। কারণ বাংলা সাহিত্য বাংলার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। আর সমাজব্যবস্থার মুখের কথাগুলো বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছাবে এটাই স্বাভাবিক। সেদিক থেকে বিবচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, নীলদর্পণ দীনবন্ধু মিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। এ বিষয়ে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘নীলদর্পণ নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালী মহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল।’ মূলত: এই নাটকটির ফলেই ইংরেজরা নীলকরদের বর্বর চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিল।সমাজবাস্তবধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের নাটকটি সার্থক।কিভাবে গোলকমাধবের পরিবার নীলকরদের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেল, সাধুচরণের কন্যা ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হলো, সাধারণ কৃষকদেরকে সর্বহারা করা হলো এ সকল বিষয় নিদারুণভাবে নাটকে চিত্রাঙ্কিত হয়েছে তা বর্ণনাতীত। শুধু সাধারণ নয় ভদ্রলোকশ্রেণীর প্রতি ও চালানো হয়েছে নির্মম অত্যাচার। বলা হয়, দীনবন্ধু মিত্র কর্মসূত্রে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করেছিলেন যা তিনি প্রয়োগ করেছেন তার নীলদর্পণে।
নাটকটি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি সমালোচকদের চোখ এড়াতে পারেনি। কেননা, কোনো লেখকই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সমালোচকেরা বলেছেন, এই নাটকে চরিত্রের দুটো দিক রয়েছে; অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণ চরিত্রের আঞ্চলিকতার কারণে অন্তর্দ্বন্দ্ব খুব বেশি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় না কিন্তু বাহ্যিক সংঘাতের ক্ষেত্রে কোনও চরিত্রই পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারেনি। নাটকের চিত্র ও দৃশ্যকল্পে জটিলতার যে রসায়ন তৈরি করা হয় তা প্রয়োগ না করার কারণে পাঠক কিংবা দর্শকমনে আগ্রহ বজায় রাখতে পারেনি। তৃণমূল মানুষের বাস্তবতা নিপুণভাবে তুলে ধরা হলেও উঁচুতলাশ্রেণির চরিত্রগুলোতে জড়তা ও কৃত্রিমতার ছাপ থেকে যায়। বিশেষ করে ট্রাজেডি রচনার ক্ষেত্রে সংযমী ও কৌশলী হতে হয়, কিন্তু এই নাটকে কোথাও কোথাও লেখক সে মাত্রা ছাড়িয়ে আতিশয্যের অবতারণা করেছেন। ফলে নাটকটি কোন কোন অংশে অতিনাটকীয় হয়ে পড়েছে। অথচ, তৃণমূল মানুষের জীবনের ব্যথা-বেদনা নিয়ে নাটকটি রচিত হয়েছিল বলে।
অধিকাংশ মানুষ এটিকে দেশের প্রথম গণনাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ইংরেজ-শক্তির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ঐক্যবদ্ধ এক শক্তির পাহাড়। যা বাঙালীদের নতুন ভোরের সূর্য দেখিয়েছিল।এতদসত্বেও নীলদর্পণ একটি সার্থক নাটক ও নীলকরদের অত্যাচারের দলিল হিসেবে বাংলার জনমানসে পরিচিত। অত্যাচারের চিত্র যেমনি ফুটে উঠেছে তেমনি প্রতিরোধের চিত্র ও আমরা লক্ষ্য করি,সেজন্য সমাজবাস্বধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে নীলদপর্ণ নাটকটিকে আখ্যায়িত করতে পারি।
সহায়ক গ্রন্থ
১. খোন্দকার সিরাজুল হক (সম্পা), “দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ”
২. বাংলা উইকিপিডিয়া
৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, “মাহবুবুল আলম”