সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম কলকাতার নিকটবর্তী নিমতা গ্রামে, পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার চুপী গ্রামে। তাঁর পিতা রজনীনাথ দত্ত ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মাতা মহামায়া দেবী ছিলেন একজন গৃহিণী। পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও পিতামহ অক্ষয় কুমার দত্তের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার প্রভাব সত্যেন্দ্রনাথের সাহিত্যিক প্রবণতাকে প্রেরণা জোগায়।
তিনি কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৯) এবং জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ (১৯০১) পাস করেন। তবে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর তিনি কাব্যচর্চার দিকে মনোনিবেশ করেন। পিতার ব্যবসায় যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রাথমিকভাবে একটি সাধারণ জীবনের পথে চললেও তাঁর কবিতার মাধ্যমে পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন।
কর্মজীবন
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কর্মজীবন মূলত কবিতা ও ছড়ার প্রতি গভীর প্রেমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি ভারতী পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্যতম কবি হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর কবিতায় ছন্দের কারুকাজের জন্য তিনি বিশেষভাবে প্রশংসিত। তাঁর কবিতা সাধারণত দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, এবং শক্তিসাধনার মতো বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং অক্ষয় কুমার বড়াল প্রমুখের কবিতায় প্রভাবিত হয়ে শুরু করলেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুসারী হলেও নিজস্ব একটি স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন। বাংলা শব্দের সাথে আরবি-ফার্সি শব্দের সংমিশ্রণ এবং কবিতার ছন্দের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা বাংলা কাব্যভাষাকে শক্তিশালী করেছে। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতার সংযোগ ঘটানোর জন্য তিনি বহু অনুবাদ করেছেন।
সাহিত্যকর্ম
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় ছন্দের প্রতিভা তাঁর বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য। তিনি ‘ছন্দের যাদুকর’ হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর কবিতায় ছন্দের নিরীক্ষা ও নতুনত্বের প্রতি তাঁর অবদান প্রশংসনীয়। তাঁর প্রাথমিক কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- সবিতা (১৯০০): এই কাব্যগ্রন্থটি সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কাজ এবং এটি তাঁকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
- সন্ধিক্ষণ (১৯০৫): এই গ্রন্থে তাঁর কাব্যিক দক্ষতার আরও উন্নতি দেখা যায়।
- বেণু ও বীণা (১৯০৬): একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতার সংকলন যা তাঁর সাহিত্যিক উৎকর্ষের পরিচায়ক।
- হোমশিখা (১৯০৭): এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন।
- ফুলের ফসল (১৯১১): এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু দেশাত্মবোধ এবং মানবপ্রীতি।
- কুহু ও কেকা (১৯১২): একটি সৃজনশীল কবিতার সংকলন যা সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে।
- তুলির লিখন (১৯১৪): এই গ্রন্থে তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তির নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
- মনিমঞ্জুষা (১৯১৫): একটি কবিতার সংকলন যা বাংলা কাব্যশাস্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
- অভ্র-আবীর (১৯১৬): এই গ্রন্থে তিনি নতুন ধরনের কবিতার নমুনা তুলে ধরেন।
- হসন্তিকা (১৯১৭): তাঁর কাব্যিক পরিসরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি বেলা শেষের গান (১৯২৩) এবং বিদায় আরতি (১৯২৪) নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এছাড়া, তাঁর অনুবাদমূলক কাজের মধ্যে রয়েছে:
- তীর্থ সলীল (১৯০৮)
- তীর্থ রেণু (১৯১০)
- ফুলের ফসল (১৯১১)
অনুবাদ কর্ম
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হলো তাঁর অনুবাদ কাজ। আরবি-ফার্সি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি, এবং ফরাসি ভাষার কবিতাগুলির সফল অনুবাদ করে তিনি বাংলাসাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেছেন। তাঁর অনুবাদকর্মে কবিতার মূল ভাষার স্বাদ ও মৌলিকতা বজায় রেখে বাংলা পাঠকদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও কৃতিত্ব
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। তাঁর কবিতা মূলত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, দেশাত্মবোধ, এবং মানবিকতা নিয়ে লেখা হয়েছে। মেথরদের মতো অবহেলিত শ্রেণির মানুষের জীবনও তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, যা তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা যেমন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে, তেমনি তাঁর কাব্যভাষা ও ছন্দের কৌশল ভবিষ্যত প্রজন্মের কবিদের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাঁর কাব্যিক দক্ষতা এবং নতুনত্ব বাংলা কবিতায় এক নতুন দিগন্ত খুলেছে, যা সাহিত্যিক সমাজে তাঁকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।
দেহাবসান
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:
“তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী-‘পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে এ শুধু প্রিয়জনের প্রশংসা নয়, এ এক ঐতিহাসিক সত্য।”