রফিক আজাদ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ – ১২ মার্চ ২০১৬) ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার এক অমর নাম। তার কবিতায় একদিকে যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানবতার গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে, তেমনি অন্যদিকে তেমনি সমাজের অভ্যন্তরীণ সংকট ও স্বাধীনতার সংগ্রামের চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। তার সাহিত্যে সৃজনশীলতা, বিশিষ্টতা এবং গভীর মানবিক অনুভূতির সাথে সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার একটি সমন্বয় ছিল। আজাদ সাহিত্যের জন্য প্রাপ্ত একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কার তার সাহিত্যিক অবদানের প্রমাণ।
জন্ম ও পারিবারিক背景
রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণগ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন একজন সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান একজন আদর্শ গৃহিণী। পরিবারে দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার জন্মের আগে মারা যায় সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলা এবং তৎপরবর্তী বোন খুকি। এইভাবে, রফিক আজাদ ছিলেন তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়।
শিক্ষাজীবন
রফিক আজাদের শিক্ষাজীবন ছিল চ্যালেঞ্জিং ও রোমাঞ্চকর। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় ভাষা শহিদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি তার এই ভালবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে কবি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় একবার বাবার হাতে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে, উদ্দেশ্য ছিল পি.সি সরকারের কাছে জাদু শেখা। তবে, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠান। কৈশোরে লাঠি খেলা শিখতেন নিকটাত্মীয় দেলু নামক একজনের কাছে। দেলু দাদা ছিলেন পাক্কা লাঠিয়াল এবং গ্রামের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব।
রফিক আজাদকে শৈশব থেকে লাঠি খেলা, সাহিত্য, ও কাব্যচর্চার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য দেলু দাদার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবের বন্ধুদের মধ্যে নিম্নশ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা তার বন্ধু ছিল। এই বন্ধুদের সাথে তার শৈশব ও কৈশোর কাটানো ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহের উৎস।
কর্মজীবন
১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক আজাদ। তার সম্পাদনায় পত্রিকাটি সাহিত্য জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া, তিনি ‘রোববার’ পত্রিকাতেও সম্পাদনার কাজ করেছেন, তবে সেখানে নিজের নাম উহ্য রেখেছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজে বাংলার লেকচারার হিসেবে কাজ করেছেন। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি, এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কাজ করেছেন। তার কর্মজীবন ছিল বহুমুখী ও প্রভাবশালী।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় রফিক আজাদ কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার সাহসিকতা ও দেশপ্রেম তাকে একটি কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।
সাহিত্যকর্ম
রফিক আজাদ এর সাহিত্যকর্ম ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তার কবিতায় দেশপ্রেম, প্রেম, জীবনযাত্রা এবং সমাজের অবক্ষয় উঠে এসেছে। তার কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ নিম্নরূপ:
- অসম্ভবের পায়ে
- সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে
- চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
- এক জীবনে
- পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি
- প্রেমের কবিতাসমগ্র
- বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে
- বিরিশিরি পর্ব
- রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা
- রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র
- হৃদয়ের কী বা দোষ
- কোনো খেদ নেই
- সশস্ত্র সুন্দর
- হাতুড়ির নিচে জীবন
- পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ
- প্রিয় শাড়িগুলো
পুরস্কার ও সম্মাননা
রফিক আজাদ তার সাহিত্যিক অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭)
- কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯)
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২)
- সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯)
- কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১)
- কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬)
- বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭)
- একুশে পদক (২০১৩)
মৃত্যু
রফিক আজাদ ২০১৬ সালের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল ক্ষতি, তবে তার সাহিত্যকর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা তাকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।
রফিক আজাদ শুধুমাত্র একজন কবি নয়, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য সম্পদ। তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে সাহিত্য ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করা যায়। তার কবিতায় যেমন মানবিক অনুভূতির প্রকাশ, তেমনি সামাজিক পরিবর্তনের আহ্বানও রয়েছে। রফিক আজাদ তার জীবন ও সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে আমাদের জন্য একটি স্থায়ী প্রেরণা রেখে গেছেন।