মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ নভেম্বর ১৯১৯ – ৩ জুন ১৯৬৯) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক। তার গবেষণা এবং কর্ম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও ধ্বনিবিজ্ঞানকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছে। তার সাহিত্য ও শিক্ষামূলক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করে। তার জীবন এবং কাজ বাংলা ভাষার গবেষণার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
জন্ম ও পরিবার
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল গণি রাজশাহীর পোরেশা গ্রামে ‘সাহু’ পরিবারে শিক্ষকতা ও ইমামতি করতেন। মায়ের নাম ছিল ময়মুন্নেসা খাতুন। একটি শিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে তার শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে।
শিক্ষাজীবন
মুহম্মদ আবদুল হাই তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন মরিচা গ্রামের কাছেই অবস্থিত বর্ধনপুর জুনিয়র মাদ্রাসায়। ১৯৩২ সালে কৃতিত্বের সাথে মাদ্রাসা সমাপ্ত করার পর রাজশাহী হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন। রাজশাহীতে তার বড় ভাই আবদুল আজিজের কাছে থাকতেন। ১৯৩৬ সালে উচ্চ মাদ্রাসা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ষষ্ঠ স্থান লাভ করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রেরণায় ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯৪২ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্র, যিনি বিএ ও এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষাজীবনের মধ্যেই ১৯৩৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১৭ বছর বয়সে মরিচা গ্রামের আনিসা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের তিনটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে হয়।
কর্মজীবন
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে এক মাস শিক্ষকতা করার মাধ্যমে। এরপর তিনি বেঙ্গল জুনিয়র এডুকেশন সার্ভিসে বাংলার লেকচারার পদে যোগ দেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৪৯ সালের ২রা মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অভ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার জন্য যান। সেখানে অধ্যাপক জে আর ফার্থের নির্দেশনায় “A Phonetic and Phonological Study of Nasals and Nasalization in Bengali” শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেন এবং ১৯৫২ সালে ডিস্টিংশনসহ এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক পদে ফিরে আসেন। ১৯৫৪ সালের ১৬ই নভেম্বর তিনি বিভাগের রিডার বা সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে রিডার থেকে প্রফেসর পদে উন্নতি লাভ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।
প্রকাশিত গ্রন্থাদি
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রকাশিত গ্রন্থগুলি বাংলা ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞান ও সাহিত্য গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি নিম্নরূপ:
- সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪) – সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
- বিলাতে সাড়ে সাত শ’ দিন (১৯৫৮) – ইংল্যান্ডে তার গবেষণা ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
- তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯) – রাজনীতি ও ভাষার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষণ।
- ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০) – ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা।
- A Phonetic and Phonological Study of Nasals and Nasalization in Bengali (১৯৬০) – বাংলা ভাষায় নাসিকা ও নাসিকাকরণের স্বরবিষয়ক গবেষণা।
- ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (১৯৬৪) – বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বের বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
- বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১৯৬৮) – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও বিশ্লেষণ (সৈয়দ আলী আহসান সহযোগে)।
মৃত্যু
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার মিশৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে গমন করেন। তবে, সেখানে তার সময়টি সুখকর হয়নি। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে তখনকার পত্র-পত্রিকায় নানা কুৎসা ছড়ানো হচ্ছিল। এ পরিস্থিতি মুহম্মদ আবদুল হাইকে মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত করে তোলে।
তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৯ সালের ৩ জুন ঢাকা শহরে চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু আত্মহত্যা না অপঘাত এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে তার অকাল মৃত্যু সমাজ সহজভাবে মেনে নেয়নি। তার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে মানুষের ঢল নেমেছিল, যা তার প্রতি দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের নিখাদ শ্রদ্ধার স্বীকৃতি।
সম্মাননা
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৬১ সালে প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সাহিত্য ও গবেষণামূলক কাজ বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার কৃতিত্ব আজও সমাদৃত।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের জীবন ও কাজ বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।