Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, যিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে অধিক পরিচিত, বাংলা সাহিত্যের এক বহুমুখী প্রতিভা। ১৯ জুলাই ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণকারী এই লেখক, নাট্যকার, কবি, এবং চিকিৎসক একাধারে সমাজের নানা স্তরে নিজের অবদান রেখেছেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত। তার লেখনীতে জীবন ও সমাজের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে, যা তাকে অমরত্ব প্রদান করেছে।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মণিহারীতে। তার পিতার নাম সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। তার পিতা ছিলেন একজন চিকিৎসক, আর মা ছিলেন গৃহবধূ। যদিও তাদের আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শিয়াখালা গ্রামে, তবুও বলাইচাঁদের জন্মস্থান ছিল বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রাম। তাদের পরিবার “কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে” নামে পরিচিত ছিল, যা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। তার অনুজ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক, যার মাধ্যমেও তাদের পরিবারে সংস্কৃতির একটি গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।

শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মণিহারী স্কুলে। পরবর্তীতে তিনি সাহেবগঞ্জ জেলার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯১৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯২০ সালে তিনি হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, তবে পাটনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি. ডিগ্রী লাভ করেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি প্যাথলজিস্ট হিসেবে ৪০ বছর কাজ করেছেন। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তার মৃত্যু হয়।

সাহিত্যজীবনের সূচনা ও বিকাশ

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তিনি প্রথমবার মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশ করেন। নিজের নাম গোপন রাখতে তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামটি বেছে নেন। তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে ১৯১৫ সালে, যখন তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তবে তিনি সাহিত্য জগতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় ব্যঙ্গ কবিতা ও প্যারডি কবিতা লেখার মাধ্যমে। এছাড়াও, তিনি প্রবাসী, ভারতী, এবং অন্যান্য সমসাময়িক পত্রিকায় নিয়মিত ছোটগল্প লিখতেন, যা তাকে বাংলা সাহিত্যের একজন স্থায়ী সদস্যে পরিণত করে।

বনফুলের সাহিত্যকর্ম

বনফুল ছদ্মনামে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এক হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোটগল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী, এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার রচনাবলীসমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, যা তার বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্মের সাক্ষ্য বহন করে।

কাব্যগ্রন্থ

বনফুলের কবিতা জীবন ও সমাজের নানান দিক তুলে ধরে। তার রচিত প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হলো ‘বনফুলের কবিতা’, ‘ব্যঙ্গ কবিতা’, ‘অঙ্গারপণী’, ‘চতুর্দশী’, এবং ‘করকমলেষু’। তার কবিতায় তিনি সমাজের প্রতি ক্ষোভ, বিদ্রোহ, এবং প্রেমের নানা দিক তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসসমূহ

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি তাকে বাংলা সাহিত্যে একজন বিশেষ স্থান দিয়েছে। তার রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫), ‘বৈতরণীর তীরে’ (১৯৩৬), ‘নিরঞ্জনা’ (১৯৫৫), ‘ভুবন সোম’ (১৯৫৭), ‘মহারাণী’ (১৯৫৮), ‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৫৯), ‘মানসপুর’ (১৯৬৬), ‘এরাও আছে’ (১৯৭২), ‘নবীন দত্ত’ (১৯৭৪), এবং ‘হরিশ্চন্দ্র’ (১৯৭৯)। এছাড়াও, তার আরও কিছু প্রখ্যাত উপন্যাস হল ‘কিছুক্ষণ’ (১৯৩৭), ‘সে ও আমি’ (১৯৪২), ‘সপ্তর্ষি’ (১৯৪৫), ‘উদয় অস্ত’ (১৯৭৪), এবং ‘গন্ধরাজ’। তার উপন্যাসগুলি সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, এবং জীবনের বিভিন্ন দিকগুলি ফুটিয়ে তুলেছে।

নাটকসমূহ

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন জীবনী-নাটকের পথিকৃৎ। তার রচিত নাটকগুলি বাংলা নাট্য সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে ‘শ্রীমধুসূদন’ এবং ‘বিদ্যাসাগর’।

প্রবন্ধ ও জীবনী রচনা

বনফুলের প্রবন্ধ ও জীবনী রচনা তার লেখনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার রচিত প্রবন্ধগুলি সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। জীবনী রচনায় তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার জীবনী রচনা শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছে।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ১৯৭৫ সালে তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭) পান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে। তার জীবদ্দশায় প্রাপ্ত এইসব পুরস্কার ও স্বীকৃতি তার সাহিত্যিক প্রতিভার প্রমাণ।

বনফুলের সাহিত্যকর্মের প্রভাব

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। তার রচিত গল্প, উপন্যাস, এবং কবিতা জীবনের নানা দিককে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। তার সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের মন জয় করেনি, বরং তা বহির্বিশ্বেও প্রশংসিত হয়েছে।

শেষ কথন

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, যিনি বনফুল নামেই বেশি পরিচিত, তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তার লেখা শুধু সাহিত্যিক মানেই উচ্চ নয়, বরং তা জীবনের নানান দিককে তুলে ধরেছে, যা আমাদের সমাজকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছে। তার সাহিত্যিক কীর্তি তাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে কলকাতায় তার মৃত্যুর পরও তার সাহিত্যকর্ম আজও জীবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক। তার রচনায় প্রতিফলিত জীবন ও সমাজের বাস্তবতা আমাদের চিন্তা ও মননের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.