আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪ – ১৯ মার্চ, ২০০১) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, সাহিত্যিক এবং সরকারি কর্মকর্তা। তার কবিতার ভাণ্ডারে দুটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে: ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ এবং ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’। এই কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অনন্য সংযোজন। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা ছিলেন এবং বাংলাদেশের কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাহিত্যকর্ম ও সরকারি জীবনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে আমরা তার ব্যাপক প্রভাব ও অবদান সম্পর্কে অবগত হতে পারি।
জন্ম ও শিক্ষা
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর জন্ম হয়েছিল বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচরের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে। তার পিতা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তানের আইন পরিষদের স্পিকার। একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর শৈশবকাল থেকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। ১৯৪৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পরপরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশা জীবন
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর পেশা জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। তবে তিনি এক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হননি; ১৯৫৭ সালে তিনি অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে দেন এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কাটে সরকারি পদে কাজ করে। ১৯৮২ সালে তিনি সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে তার দুই বছরের দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কর্মজীবন ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৯২ সালে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে তিনি এই সংস্থা থেকে পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং একটি বেসরকারি সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যে অবদান
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একজন প্রতিভাবান কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার কাব্যকর্মে তিনি আঙ্গিক ও শব্দের যোজনা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তার কবিতার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র স্বর শোনা যায়, যা তাকে অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা করে তোলে। লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার কবিতায় প্রকৃতির রূপ ও রঙের বিচিত্রিত চিত্রায়ণ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো:
- সাত নরীর হার (১৯৫৫): এই কাব্যগ্রন্থে তিনি প্রেম, প্রকৃতি এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াবলী নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। এখানে তার ভাষার শৈল্পিক ব্যবহার এবং উপমা ও রূপকের জটিলতা পাঠককে মুগ্ধ করে।
- কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০): এই কাব্যগ্রন্থে প্রেমের ভাবনার পাশাপাশি সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এখানে তিনি জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যা সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
- কমলের চোখ (১৯৭৪): এই কাব্যগ্রন্থে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের চিত্র তুলে ধরেছেন। এখানে কবির চিন্তার গভীরতা এবং সমাজের প্রতি তার মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
- আমি কিংবদন্তির কথা বলছি (১৯৮১): এই দীর্ঘ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। এখানে তিনি বাঙালির সংগ্রাম, সাহস এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কবিতাটি তার সাহিত্যের একটি মাইলফলক এবং এটি তাকে বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী স্থান প্রদান করেছে।
- সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২): এই কাব্যগ্রন্থে কবি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। এখানে ধৈর্য, সহনশীলতা এবং অপেক্ষার প্রতীকী ব্যবহার কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
- প্রেমের কবিতা (১৯৮২): এই গ্রন্থে তিনি প্রেমের বিভিন্ন রূপ এবং তার সংবেদনশীলতা তুলে ধরেছেন। প্রেমের সংজ্ঞা এবং তার মর্মার্থ এখানে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
- বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩): এই দীর্ঘ কবিতায় তিনি মানব জীবনের সংগ্রাম এবং সাহসের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এটি বাংলা সাহিত্যের এক বিরল সৃষ্টি।
- আমার সময় (১৯৮৭): এই কাব্যগ্রন্থে কবি তার সমসাময়িক সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর আলোকপাত করেছেন। এখানে তিনি তার নিজের সময়ের মূল্যায়ন করেছেন এবং তার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
- নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১): এই সংকলনে তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা তাকে বাংলা কবিতার জগতে এক উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
- আমার সকল কথা (১৯৯৩): এই গ্রন্থে কবি তার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি নিয়ে কথা বলেছেন। এখানে তার চিন্তাধারা এবং মানসিকতার প্রতিফলন পাওয়া যায়।
- মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ: এই কাব্যগ্রন্থে প্রেম, প্রকৃতি এবং মানবজীবনের নানাদিক নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। এখানে তার কাব্যিক দক্ষতা এবং শব্দের মাধুর্য পাঠককে মুগ্ধ করে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার সাহিত্যিক অবদানের জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) এবং একুশে পদক (১৯৮৫)। এই পুরস্কারগুলো তার সাহিত্যিক কর্ম এবং বাংলাভাষার প্রতি তার অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।
সমাপ্তি
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তার কবিতা শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত সাহিত্যচর্চা করে গেছেন এবং তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সাহিত্যকর্ম চিরকাল বাঙালির মননে জীবিত থাকবে এবং আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।