শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ – ১৭ আগস্ট ২০০৬) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও বাংলাদেশের কবি। তার সাহিত্যকর্ম ও জীবনযাত্রার মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতার অঙ্গনে একটি অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা
শামসুর রাহমানের জন্ম পুরনো ঢাকার মাহুতটুলি এলাকায়, নানাবাড়িতে। তার বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম ছিলেন। তিনি ১৩ জন ভাই-বোনের মধ্যে ৪র্থ ছিলেন। শৈশব ও কৈশোরে পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠেন এবং পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। যদিও তিনি মূল পরীক্ষা দেননি, ১৯৫৩ সালে পাস কোর্সে বিএ পাশ করেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (প্ৰিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
পেশা
শামসুর রাহমানের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজে সহসম্পাদক হিসেবে। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক মর্নিং নিউজে ফিরে আসেন এবং ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে দৈনিক পাকিস্তান (স্বাধীনতা উত্তর দৈনিক বাংলা) এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত এই পদে থাকেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। সামরিক সরকারের সময় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং পরে অধুনা নামক একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যধারা
শামসুর রাহমান বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ হিসেবে পরিচিত। তার কবিতা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রকাশ ঘটিয়েছে।
তিনি ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ করেন এবং দ্রুততার সাথে উভয় বাংলায় কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার কবিতার ভাষা ও উপস্থাপনা আধুনিক বাংলা কবিতার জন্য এক নতুন ধারার সূচনা করে। শামসুর রাহমানের কবিতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিক্রিয়াশীল কবি ও শহুরে কবি
শামসুর রাহমান তার কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন স্বৈরশাসক ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ‘হাতির শুঁড়’ কবিতার মাধ্যমে আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে তিনি সরকারের পদে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্টের পতাকা দেখে তার কবিতা ‘আসাদের শার্ট’ রচনা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত কবিতা লিখেন এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও প্রত্যাশার কথা প্রকাশ করেন।
শিশুবান্ধব কবি
শামসুর রাহমান শিশুদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দরদ প্রকাশ করেছেন। তিনি শিশুদের জন্য অনেক বই লিখেছেন এবং শিশুদের অনুষ্ঠানে সরবভাবে উপস্থিত থেকেছেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা’র প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন এবং তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটিয়েছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
শামসুর রাহমানের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের তালিকা:
- প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০)
- রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩)
- বিধ্বস্ত নিলীমা (১৯৬৭)
- নিজ বাসভূমে (১৯৭০)
- বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২)
- উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ (১৯৮২)
- শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭)
- প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮)
- বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮)
- সৌন্দর্য আমার ঘরে (১৯৯৮)
- ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি (২০০২)
সম্মাননা ও পুরস্কার
শামসুর রাহমান তার সাহিত্যকর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার
- একুশে পদক
- স্বাধীনতা পদক
- জীবনানন্দ পুরস্কার
শামসুর রাহমানের সাহিত্যকর্ম ও ব্যক্তিগত জীবন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমর স্থান অধিকার করে আছে। তার মৃত্যুর পরও তার কবিতার মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত হয়ে আছেন।